Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কুমাতা কখনও নয়?

নোবিদদের একটা বড় অংশ অবশ্য মনে করছেন, এ নিয়ে এত ‘গেল গেল’ রব তোলার কিছু হয়নি। তাঁদের মতে, মাতৃত্ব আসলে একটা ‘কনসেপ্ট’, যা বিশ্ব জুড়ে সযত্নে লালিত হচ্ছে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

মাস কয়েক আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ধারে কাপড়ে মুড়ে কয়েক দিনের শিশুকে ফেলে যিনি ওয়ার্ড থেকে বেপাত্তা হয়েছিলেন, তিনি শিশুটির মা। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতলের বাসিন্দারা তিন বছর আগের এক রাতে ঘুম ভেঙে সদ্যোজাতের কান্না শুনেছিলেন। পর দিন সকালে চোখে পড়েছিল রাস্তার ধারে গাছের নীচে ঠান্ডায় নীল হয়ে যাওয়া শিশুর মৃতদেহ। শিশুটিকে সম্ভবত তার মা-ই ফেলে যান। আর সেই কবে সদ্যোজাতকে জলে ভাসিয়ে বরাবরের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গিয়েছেন যে মহিলা, সেই কুন্তী-ও মা-ই।

শিনা বোরা হত্যাকাণ্ডে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় মা, আরুষি হত্যায় অভিযুক্ত নূপুর তলোয়ারও মা। বহু পরিবারে তিন-চার বছর বয়স থেকে মেয়েকে তার দাদা/কাকার যৌন নিগ্রহের শিকার হতে দেখেও চুপ করে সব হজম করেন যাঁরা, তাঁরাও জন্মদাত্রীই। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাধ্য হয়েই হোক, নিরাপত্তাহীনতার ভয় থেকে বা, মনোরোগের শিকার হয়েই হোক, সরাসরি মায়ের দ্বারা বা মায়ের জ্ঞাতসারে সন্তানের ক্ষতির ঘটনা সম্পূর্ণ বিরল নয়। তা হলে পুরুলিয়ার সুচবিদ্ধ, মৃত শিশুটির মাকে ঘিরে এমন গেল-গেল রব উঠছে কেন? এক বৃদ্ধের যৌন বিকৃতি এ ক্ষেত্রে যতটা না চর্চার বিষয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চর্চা চলছে এই নিয়ে যে মা কী ভাবে সব জেনেও চুপ করে রইলেন? প্রশ্ন উঠেছে, নিজের মাথার ওপরের ছাদটা বাঁচাতে, নিজের দু’বেলার অন্ন সংস্থান করতে কোনও মা কি সন্তানের ক্ষেত্রে এত দূর নিষ্ঠুর, নিস্পৃহ থাকতে পারেন? না কি এটা গভীর কোনও মানসিক অসুখ?

মহিলারা তো বটেই, পুরুষরাও অনেকে বলছেন, ছেলের খেলায় মনোযোগ নেই বলে বছর কয়েক আগে বাবা যখন ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে ছেলেকে মেরে ফেলেছিলেন তখন প্রাথমিক ভাবে তা মানতে অসুবিধা হলেও এতটা অবাক তাঁরা হননি, যতটা এখন হচ্ছেন। বার বার মনে হচ্ছে, নিজের যত অসহায়তাই থাকুক, মা কী করে এমন করেন?

মনোবিদদের একটা বড় অংশ অবশ্য মনে করছেন, এ নিয়ে এত ‘গেল গেল’ রব তোলার কিছু হয়নি। তাঁদের মতে, মাতৃত্ব আসলে একটা ‘কনসেপ্ট’, যা বিশ্ব জুড়ে সযত্নে লালিত হচ্ছে। যে সম্পর্ককে মহত্ত্ব আর স্বার্থহীনতার মোড়কে মুড়ে রাখা হয়েছে আবহমানকাল, তার বিচ্যুতির এই সব নজির সমাজকে অস্বস্তিতে ফেলছে ঠিকই, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ নতুন কিছু নয়।

এখনও পর্যন্ত পুলিশ যা জানতে পেরেছে, তা এই রকম। পুরুলিয়ার শিশুটির মা জানতেন তাঁর সন্তানকে দিনের পর দিন অত্যাচারিত হতে হয়। তবু তিনি কোনও প্রতিবাদ করেননি। কাউকে জানাননি। বলা হচ্ছে, তাঁর নিজের কোনও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। ওই বৃদ্ধ তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করলে দু’বেলার খাওয়া আর মাথার ওপরের ছাদটা চলে যেত, তাই তিনি সব জেনেও চুপ করে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে আইনের চোখে তিনি অপরাধী তো বটেই, কিন্তু সমাজের চোখে আরও বড় অপরাধী হয়ে উঠেছেন। বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অন্য যে ঘটনাটি নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে, সেখানেও মা-ই কাঠগড়ায়। একে কন্যাসন্তান, তার ওপরে তার ক্যানসারের আশঙ্কা, এই দুইয়ের যোগফলে সন্তানকে ফেলে এসেছিলেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে শিশুটির বাবা আবার দাবি করেছেন তিনি বিষয়টার বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। তাঁকে নাকি জানানো হয়েছিল, মেয়ে মারা গিয়েছে। তিনি সেটাই বিশ্বাস করেছিলেন। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তাঁর সন্তানকে ও ভাবে ফেলে আসা হয়েছে। কেন মা এমন করেছিলেন? অভাবের সংসারে একটা রুগ্ণ পেটকে বাদ দিয়ে সংসারের সুরাহা করতে চেয়েছিলেন? মায়েরা এমন করতে পারেন?

মনোবিদদের অনেকেই আকবর এবং বীরবলের গল্প মনে করিয়েছেন। আকবর বীরবলকে প্রশ্ন করেছিলেন, এক জন মায়ের কাছে নিজের জীবনের দাম বেশি, না কি সন্তানের? উত্তরে বীরবল এক গভীর চৌবাচ্চায় একটি বানরছানা ও বানর মা-কে রেখে সেটি জল দিয়ে ভর্তি করতে থাকেন। মা বানর বহুক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চাকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যখন বোঝে, কিছুতেই তাকে তোলা যাবে না, তখন একাই কোনও মতে লাফিয়ে উঠে আসে। বীরবল আকবরকে বলেন, ‘‘বুঝতে পারলেন?’’

এটাই সব ক্ষেত্রে ঘটবে, এমন নয়। বহু মা সন্তানকে বড় করতে নিজের সবটুকু উজাড় করে চেষ্টা করেন। তাকে বাঁচাতে মা নিজের জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেন। কিন্তু উল্টোটাও ঘটে। কোন পরিস্থিতিতে কে কী করবেন, তা নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের গঠনের উপরে। মনোবিদ অনিরুদ্ধ দেব জানালেন, নানা ধরনের সাইকোলজি টেস্ট হয়। ধরা যাক, একটা ট্রেন খুব জোরে যাচ্ছে। শ’পাঁচেক যাত্রী রয়েছেন ওই ট্রেনে। যে লাইনে ট্রেনটি যাচ্ছে সেখানে কিছু দূরে একটা ব্রিজ ভাঙা। দুর্ঘটনায় এত জন মানুষের জীবনহানি অনিবার্য। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে একটি সুইচ টিপলেই ট্রেনটি অন্য লাইনে চলে যাবে। এতগুলো প্রাণ রক্ষা পাবে। কিন্তু সুইচ টিপে ট্রেনটিকে যে লাইনে পাঠাচ্ছেন সেখানে সাধারণ ভাবে ট্রেন চলে না। তাই ওই লাইনের ওপরে আপনার সন্তান খেলছে। ট্রেনটি ওই লাইনে ছুটলে কয়েক মিনিটের মধ্যে আপনার সন্তান ট্রেনে কাটা পড়বে। এই অবস্থায় আপনি কী করবেন? যদি বলেন, সুইচ টিপবেন না, কারণ আপনার সন্তানের জীবন আপনার কাছে সবচেয়ে দামি, তখন জানানো হবে, ওই ট্রেনে কিন্তু আপনার বাবা-মাও রয়েছেন। কী করবেন আপনি? এই দোলাচলে এক এক জনের সিদ্ধান্ত এক এক রকম।

অনিরুদ্ধবাবুর বক্তব্য, বাড়িতে আগুন লেগেছে দেখলে যে মা সন্তানকে বার করে আনার জন্য দৌড়ে ভিতরে ঢোকেন, তিনি কি নিজে মারা যাবেন সে কথা ভেবে ঢোকেন? তিনি এই বিশ্বাস থেকে ঢোকেন যে হয়তো তিনি এবং তাঁর সন্তান দুজনেই নিরাপদে বেরোতে পারবেন। যেখানে এই বিশ্বাসটা রাখার মতো পরিস্থিতি থাকে না সেখানেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবটা বড় হয়ে ওঠে। তখন তিনি কী করবেন সেটা তাঁর মানসিক গঠনই তাঁকে বলে দেয়।

মনোবিদ রিমা মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, মায়েরা যে সব সময় সন্তানের স্বার্থরক্ষা করে কাজ করেন তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। তাঁর কথায়, ‘‘মাতৃত্বকে আমরা একটা সহজাত প্রবৃত্তি বলে ধরে নিই। যেন যে কোনও মেয়ে মা হলেই তিনি ভালবাসা, মায়া, মমতা ধৈর্যের প্রতীক হবেন। সর্বদা কিন্তু সেটা হয় না। সন্তানের প্রতি মায়েদের নিষ্ঠুরতাও থাকে। খুন্তি গরম করে গায়ে ছেঁকা দেওয়া, ভারী জিনিসপত্র ছুড়ে মারা কিংবা ‘তোর জন্মের পর আমার জীবনটা নরক হয়ে গেল’ জাতীয় কথা বলাও কম অত্যাচার নয়। কেউ বলতেই পারেন, এগুলো রাগের বশে বা কোনও ক্ষোভ থেকে হয়। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে রাগের মধ্যে অনেক সময় মনের কথাটা বেরিয়ে আসে।’’

প্রকৃতির নিয়মে সন্তান ধারণ একটা প্রক্রিয়া। তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বলেই সকলে এক রকম, তা মনে করার কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পান না মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার। তাঁর মতে, সব স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরের প্রতি সমান বিশ্বস্ত না হতে পারেন, সব বন্ধু যদি পরস্পরকে সমান ভালবাসতে না পারেন, সব সন্তান যদি বাবা-মায়ের প্রতি সমান কর্তব্যপরায়ণ না হতে পারেন, তা হলে সব মা সন্তানের প্রতি সমান স্নেহশীল হবেন সেই নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? তাঁর মতে, ‘‘যদি কেউ অসুস্থ হয়ে থাকেন তা হলে তাঁকে অসুস্থ হিসেবেই দেখা হোক। অপরাধ করে থাকলে অপরাধী হিসেবে দেখা হোক।’’

মনোবিদদের মতে, পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার ঘটনাকে সামগ্রিক ভাবে মাতৃত্বের অবক্ষয় হিসেবে ধরে নেওয়ার যুক্তি নেই। হতে পারে, এগুলো মানসিক ‘ডিসঅর্ডার’, যা যে কোনও মানুষকে আক্রমণ করতে পারে যে কোনও সময়েই। তিনি ঠিক-বেঠিকের বোধ হারিয়ে ফেলতে পারেন। হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। কাছের মানুষকে আক্রমণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রোগটাকে রোগ হিসেবে দেখাই ভাল। আবার তিনি যদি রোগী না হন, সে ক্ষেত্রে জেনেবুঝে নিজে নিরাপদ থাকার জন্য যেটা প্রয়োজন মনে করছেন সেটাই করছেন। সেই স্বার্থপরতাও এক ধরনের প্রবৃত্তি, অন্য যে কোনও মানুষের মতো মায়েরও তা থাকতে পারে।

সকলকে এক ছাঁচে ঢেলে ফেলাটা আমাদের অভ্যাস। সমস্যাটা বোধহয় সেখানেই। শুধু তা-ই নয়, বাবা কোনও অপরাধ করলে সেটা নিয়ে সমাজে এমন গেল-গেল রব ওঠে না, ওঠে মা-কে নিয়েই। এও এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফল বলে মনে করছেন মনোবিদদের অনেকেই।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE