Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কে বলল, ওঁরাই মুসলমানের মুখপাত্র

গ্রামের সবাই যদি ‘আপনি মোড়ল’কে মেনেই নেয়, তা হলে অন্যরা আর কী-ই বা করে? চুপ করেই থাকতে হয় তাদের, স্বঘোষিত মোড়লটিকে সর্বস্বীকৃত মোড়ল বলে মেনে নিতে হয়।

স্ব-ক্ষমতা? আপন কথা বলার অধিকার কিন্তু মুসলিম মেয়েরা উত্তরোত্তর দাবি করছেন।

স্ব-ক্ষমতা? আপন কথা বলার অধিকার কিন্তু মুসলিম মেয়েরা উত্তরোত্তর দাবি করছেন।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

গ্রামের সবাই যদি ‘আপনি মোড়ল’কে মেনেই নেয়, তা হলে অন্যরা আর কী-ই বা করে? চুপ করেই থাকতে হয় তাদের, স্বঘোষিত মোড়লটিকে সর্বস্বীকৃত মোড়ল বলে মেনে নিতে হয়। সম্প্রতি অবশ্য এ দিক ও দিকে ‘আপনি মোড়ল’-এর বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে। সেই ভরসায় অনেক দিনের জমে-থাকা একটা প্রশ্ন করেই ফেলা যাক। এই যে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, তারা কি গোটা দেশের মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি? কী করে হল এমন, কোন প্রক্রিয়ায়? পার্সোনাল ল বোর্ড নামে একটি সংগঠন থাকতেই পারে, তাদের মতামতও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের বক্তব্যই যে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থান, একমাত্র শিরোধার্য অবস্থান, কে তা ঠিক করে দিল? দেশে তো আরও অনেক মুসলিম সংগঠন আছে, ধর্মীয় এবং নাগরিক সংগঠন— যারা অনেক রকমের মতামতের অধিকারী! সেগুলি কী বলে, কী করে, আমরা কি জানি ঠিকঠাক? না, জানি না। তাই, বহুমত বহুপথের গণতন্ত্রের মধ্যে বসেও আমাদের ধারণা দাঁড়িয়ে যায়, এই সংগঠনের হাতেই গোটা ভারতীয় মুসলিম সমাজের পরম ও চরম অবিভাজ্য ক্ষমতার টিকিটি বাঁধা রয়েছে।

ক্ষমতার খেলাটা পরিষ্কার। উদ্দেশ্যও স্পষ্ট: ল বোর্ড-এর বিপক্ষে যে কেবল হিন্দুত্ববাদীরাই তর্ক করছে না, মুসলিম সমাজের ভেতর থেকেও গাদা গাদা প্রতিবাদ আসছে, পাকেচক্রে সেই দারুণ সত্য বাস্তবটাকে ভুলিয়ে দেওয়া। এই যেমন, এই মুহূর্তে তিন তালাক বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে ল বোর্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যত ঘন এবং তীব্র, নারী থেকে পুরুষ, সেলেব্রিটি থেকে সাধারণ মুসলিম নাগরিক, রাজনৈতিক থেকে ছাপোষা সামাজিক, কত রকম সেই প্রতিবাদের ধরন; ইসলামি শরিয়ত থেকে ভারতীয় সংবিধান পর্যন্ত কত বিচিত্র সেই প্রতিবাদের যুক্তি। অথচ আমরা শুনছি, জানছি, এবং, শেষ অবধি মানছি কেবল এআইএমপিএলবি-র অবস্থানের কথাই। শুনছি যে, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টকে শাসিয়েছেন— ভারতে সামাজিক সংস্কারের নামে পার্সোনাল ল-এর কোনও রকম পরিবর্তন যাতে না হয়! শুনছি যে, তালাক আছে বলেই নাকি মুসলিম সমাজে স্ত্রীদের মেরে না ফেলে ডিভোর্স দিয়ে অন্তত বাঁচিয়ে রাখা যায়! শুনছি যে, বহুবিবাহ নাকি সমাজের মঙ্গলের জন্যই অবশ্যপালনীয়, না হলেই অনৈতিক কাজকর্ম হু হু করে বাড়বে। শুনছি যে রক্ষিতা কিংবা অবৈধ সম্পর্ক আটকাতেই দুই-তিন-চারটি করে স্ত্রী দরকার। শুনছি যে, পুরুষ যেহেতু শক্তিশালী, মেয়েরা দুর্বল, তাই স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাইতেই পারেন, আর সেই দিক দিয়ে তালাক একটি অতি উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা। অসাধারণ উক্তি এবং যুক্তি সব, মিডিয়া ও মিডিয়াপুষ্ট জনগণ হইহই করছে তা নিয়ে। তালাক নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে মুসলিম প্রতিক্রিয়া বলতে কেবল সেগুলিই আপাতত জ্বলজ্বল করছে।

ভিন্ন মতের অধিকার

মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের এই সব চমৎকারা বাণীতে দেশের হিন্দুত্বের পারদ স্বভাবতই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যত বার তারা মুখ খুলছে, অন্তত হাজার পঁচিশ করে বাড়ছে আরএসএস-এর সমর্থক সংখ্যা! মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বিপরীত রকমের চমৎকারা বাণীধারা প্রবাহিত হচ্ছে। যেন পার্সোনাল ল বোর্ডই সব, আর কোনও মুসলিম এ দেশে নেই, আর কোনও মতও তাদের নেই। এ দিকে ২০০৫ সাল থেকে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’-এর পাশাপাশি যে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম উইমেন পার্সোনাল ল বোর্ড’ আছে, এআইএমপিএলবি-র থেকে আলাদা হয়েও শরিয়ত আইনের উপর দাঁড়িয়েই যারা মুসলিম নারীর অধিকারের লড়াই চালায়,— তাদের থেকে কিন্তু এসেছে একেবারে ভিন্ন বক্তব্য। তাদের প্রতিনিধি শায়েস্তা অম্বরের মত, শরিয়ত মতে তিন তালাক অসিদ্ধ। ইরান, তুরস্ক, বাংলাদেশ, এমনকী পাকিস্তানেও তাই তালাক মানা হয় না।

আর একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠান ভারতীয় মহিলা মুসলিম সংগঠন। মসজিদ কিংবা দরগা প্রবেশের অধিকার থেকে শুরু করে তালাক, সব রকম নারী-বিতর্কেই তাঁদের প্রগতিশীল অবস্থান ইতিমধ্যে পরিচিত। এর প্রতিনিধি নুরজাহান সাফিয়া নিয়াজ এবং জাকিয়া সোমান ঘোষণা করেছেন, তালাক কোরান-বিরোধী। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন তাঁরা, ভারতের দশটি রাজ্যে হাজার-পাঁচেক মুসলিম মেয়েকে নিয়ে করা সমীক্ষার ফলাফলও জুড়ে দিয়েছেন তাতে। দেখা যাচ্ছে ৯২ শতাংশ মুসলিম মেয়েই তালাক-এর উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা চায়, আর ৯১ শতাংশ চায় বহুবিবাহে আইনি নিষেধ। সুতরাং বিএমএমএস-এর সিদ্ধান্ত, তালাক কোনও ধর্মের বিষয় নয়, ধর্মের নামে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচার ও কায়েমি স্বার্থপূরণের নিদর্শন।

এঁরাও সব নন। অনেক মুসলিমই এই বিতর্কে কোরান-শরিয়তের ধার পর্যন্ত ধারতে নারাজ। পার্সোনাল ল-এর মধ্যে যেতে তাঁরা অনিচ্ছুক, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সমর্থক তাঁরা। তাঁরা বলছেন ব্যক্তি-অধিকারের কথা, সাংবিধানিক অধিকারের যুক্তিতে নারী-অধিকারের কথা। জাভেদ আখতার পার্সোনাল ল বোর্ডের বিরুদ্ধে অসাংবিধানিকতার অভিযোগ তুলেছেন। আলিগড়ের সমাজকর্মী মারিয়া আলম উমর বহু মুসলিম নারীর মুখপাত্র হিসেবে জানিয়েছেন: তিন তালাক তো নিষিদ্ধ করতে হবেই, তার সঙ্গে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও নিষিদ্ধ হোক! যে প্রতিষ্ঠান ন্যূনতম রাখঢাকটুকুও না রেখে সংকীর্ণতম পুরুষ-তন্ত্রের অশ্লীল চর্চা করে, তাকে আইনমতে নিষিদ্ধ করা হবে না কেন? ‘কেবল তিন তালাক নয়, সব বিষয়ে এদের দৃষ্টিভঙ্গি নির্লজ্জ ভাবে নারীবিরোধী।’ আলিগড়েরই উদ্যোগকর্মী ও নারী-আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য সাজিয়া সিদ্দিকির বক্তব্য একই রকম চাঁচাছোলা: বিবাহিত পুরুষের অধিকার বিবাহিত নারীর অধিকারের চেয়ে বেশি, একুশ শতকের ভারতে বসে যারা এ কথা বলে, তাদের মুখ বন্ধ করা জরুরি, এক্ষুনি। গোটা উত্তর ভারত জুড়ে সাবা নকভির মতো বহু সাংবাদিক ও মানবাধিকার-কর্মীরা একের পর এক ক্ষিপ্ত টুইট করছেন, প্রতিটিরই বক্তব্য এই রকম।

গুনতে বসলে সংখ্যাটা তাই কম হবে না। কে বলতে পারে, এঁরা আর একটু মান্যতা ও স্বীকৃতি পেতেন যদি, ভারতীয় মুসলমান সমাজে একটা উল্টো ঢেউ শুরু হত না? কিন্তু না, সেই চেষ্টাটাই যেন ভেতর থেকে কোনও ভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। না কংগ্রেস, না বিজেপি, না মুসলিম নেতৃবৃন্দ— এই ভিন্ন স্বরগুলিকে সামনে আনতে কারও তেমন আগ্রহ নেই। সংবাদমাধ্যমেও এ সব খবর প্রান্তিক হয়েই পড়ে থাকে। অথচ এটাই কি রাজনীতি বা সামাজিক আন্দোলনের একটা বড় কাজ হওয়ার কথা ছিল না?

মজা সেখানেই। এআইএমপিএলবি-র খেলায় তাল মেলায় সকলে মিলে। সব মিলিয়ে একটা ভুল, বানানো-ফাঁপানো একত্বের ছাঁচ তৈরি হয়। দেশের সমস্ত মুসলিম একটা অনন্য ‘ক্যাটেগরি’ হয়ে ওঠে, আর তার প্রতিনিধিত্বের জন্য দরকার হয় একটি একক ও অবিভাজ্য প্রতিষ্ঠান, যারা নিজেরাই নিজেদের ‘সর্বময়’ বা ‘সোল স্পোকসম্যান’ বলে প্রতিষ্ঠান করবে। স্বাধীনতার আগে মুসলিম লিগ ও তাঁর নেতা জিন্নার বেলায়ও ঠিক এমনই হয়েছিল। দেশের নানা জায়গায় নানা মুসলিমের নানা মত সে দিন লিগের স্বঘোষিত এককত্বের হুঙ্কারের তলায় চাপা পড়েছিল।

বৃত্ত ভাঙবে কে

‘সোল স্পোকসম্যান’ হওয়ার যে খেলা, তার আকর্ষণটা হল, সব পক্ষেরই এতে ভারি সুবিধে। এই পক্ষের ক্ষমতাধারীরা আরও ক্ষমতা পেতে পারেন। ও পক্ষকেও ঝামেলা পোয়াতে হয় না, তাঁরা ধরেই নেন, এঁয়ারা যা বলবেন, সেটা মেনে নিলেই মঙ্গল, বেশি ঘাঁটালে যদি ভোট ভেঙে যায়! এই চিন্তাতেই রাজীব গাঁধী সে দিন শাহ বানো মামলায় মানে মানে ইতি টেনেছিলেন, পার্সোনাল ল বোর্ডের মত সংবিধানবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাকেই মান্যতা দিয়ে মুসলিম সমর্থনটি নিশ্চিত করেছিলেন। এই চিন্তাতেই কোনও কংগ্রেস সরকার পার্সোনাল ল বা পার্সোনাল ল বোর্ড কিছুতেই নাক গলাতে চায়নি। এই জন্যই মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে নিষিদ্ধ হলেও সংখ্যালঘু মুসলিমের দেশ ভারতে তিন তালাক চলমান থেকেছে। ভারতীয় সংখ্যালঘু তার পরিচিত উৎকণ্ঠায় গোঁড়া ধর্মবাদীদের চটায়নি, আর ভারতীয় সংখ্যাগুরু ভেবে নিয়েছে গোঁড়া মুসলিমরা খুশি থাকলেই সব মুসলিম খুশি, ভোটও নিশ্চিন্তে বেশি।

এই নিদারুণ অশুভ বৃত্তটি ভাঙার দায়িত্ব কিন্তু মধ্যপন্থী মুসলিমদেরই নেওয়ার কথা ছিল। যত অন্য স্বর, অন্য বার্তা, সবগুলিকে আঁকড়ে ধরা জরুরি ছিল, বাকিদের শোনানোর প্রয়োজন ছিল। তবেই বোঝা যেত, এআইএএমপিএলবি-ই সব নয়, অন্যরাও আছে। সেটা হয়নি। তাই অতি দ্রুত একটা ভয়ানক পরিণতির দিকে চলেছে আমাদের দেশ, যেখানে কেবল হিন্দুত্ববাদী ভোটাকাঙ্ক্ষীরাই মুসলিম সমাজের অন্তঃস্থিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে পা ফেলেন, আর সংবিধানের অধিকার ধ্বনিত হয় কেবল হিন্দু রক্ষণশীল অসাম্যবাদীদের অসহিষ্ণুতার ঢাল হিসেবে। দুই দিকের মধ্যবাদীরা কেবল ভাসেন তাঁদের যাচিত নৈঃশব্দ্যের অপরিসীম বিপন্নতায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE