Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ভারত আমার

ছাত্রনেতা দেশদ্রোহের দায়ে গ্রেফতার হন। পাকিস্তানি শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিল হয়। জাতীয়তাবাদের মাপকাঠিতে ধারাভাষ্যের বিচার তো হবেই! ২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তিবাদী হত্যা, মেধাবী দলিত ছাত্রের মৃত্যু, ছাত্রনেতার গ্রেফতারি, গোমাংস ভক্ষণের গুজবে সংখ্যালঘু হত্যা— এই রকম নানা ‘বড়’ ঘটনার অভিঘাত আছড়ে পড়েছে আমাদের চিন্তন জগতে।

তাজুদ্দিন আহমেদ
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০০:৫১
Share: Save:

২০১৪ সালে কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তিবাদী হত্যা, মেধাবী দলিত ছাত্রের মৃত্যু, ছাত্রনেতার গ্রেফতারি, গোমাংস ভক্ষণের গুজবে সংখ্যালঘু হত্যা— এই রকম নানা ‘বড়’ ঘটনার অভিঘাত আছড়ে পড়েছে আমাদের চিন্তন জগতে। তীব্র বিতর্ক হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলি নিয়ে। এর পাশাপাশি আরও কিছু ‘ছোট’ ঘটনা থেকেছে প্রচারের আলোর বাইরে, কিংবা এক প্রান্তে। সম্প্রতি সেই রকম একটি ঘটনার সূত্রপাত হয় মাইক্রোব্লগিং সাইট টুইটার-এ অমিতাভ বচ্চনের মন্তব্য দিয়ে। তাঁর অভিযোগ, আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলায় সময় এক ভারতীয় ধারাভাষ্যকার নিজের দেশের খেলোয়াড়দের প্রশংসা না করে ক্রমাগত বাংলাদেশের খেলার প্রশংসা করছিলেন।

বলিউডের এই মহাতারকা আজকের ভারতের এক জন আইকন। দিন কয়েক আগেই ভারত পাকিস্তান খেলার সূচনায় তিনি দরাজ গলায় দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর অভিযোগে অন্তর্জাল জগতে বেশ একটা হুলুস্থূল পড়ে যায়। বিসিসিআইয়ের কোষাধ্যক্ষ, ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সহ বহু মানুষ তাঁর সঙ্গে একমত হন। অভিযুক্ত ধারাভাষ্যকার অতি দ্রুত নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যা দেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, খেলার ওই টানটান উত্তেজনার মুহূর্তে তিনি ওয়ার্লড-ফিড অর্থাৎ সারা বিশ্বের দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেলে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন। কেবলমাত্র ভারতীয় দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট চ্যানেলে যে ভাবে ভারতীয় খেলোয়াড়দের প্রশংসা করা হয়, (যেমনটি ভারতের এক প্রাক্তন আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান করছিলেন) সেটি এই ক্ষেত্রে ঠিক নয়, কারণ এ ক্ষেত্রে দর্শকদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ পাকিস্তান ইংল্যান্ড, এমনকী আমেরিকার ক্রিকেটভক্তরাও। এই ব্যাখ্যার পর ব্যাপারটি মোটের ওপর থিতিয়ে যায়। সত্যিই কি থিতিয়ে যায়? না কি কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়?

অভিযুক্ত ধারাভাষ্যকার যুক্তি হিসাবে ওয়ার্লড-ফিড এর কথা বলেছেন, কিন্তু বলেননি ধারাভাষ্যকার হিসাবে তাঁর কর্তব্যের কথা, যা দাবি করে নিরপেক্ষতা। তাঁর উত্তর শুনে মনে হতে পারে যে, সুযোগ থাকলে তিনিও কেবলমাত্র ভারতীয় খেলোয়াড়দেরই প্রশংসা করতেন। তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, নিজের দেশের বিরুদ্ধে অন্য কোনও দেশের খেলোয়াড় ভাল খেললে তার প্রশংসা করা অনুচিত? দেশভক্তির ছকে বাঁধা নিক্তিতে মেপে সেই প্রশংসা কি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে? সেই অপরাধে অপরাধী হবার ভয়েই কি বাক্যবাগীশ ধারাভাষ্যকার ওয়ার্লড ফিড-এর বাধ্যবাধ্যকতার আশ্রয় নিয়েছেন?

এই রকম সব প্রশ্ন ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সীমান্তের ও পারে বিরাট কোহালির পাকিস্তানি ভক্তকে অতি সম্প্রতি হাজতবাস করতে হয়েছে। ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্য অনেকের কাছেই প্রশ্নগুলি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সত্যি তো, দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখড় ছাত্রনেতা যখন স্লোগান দেবার অপরাধে গ্রেফতার হন, জগদ্বিখ্যাত পাকিস্তানি গায়কের অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয় দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের চাপে, কিংবা স্বঘোষিত যোগগুরু ‘ভারত মাতা কি জয়’ প্রসঙ্গে অনায়াসে অন্যের মাথা কেটে দেবার হুমকি দেন, তখন দেশভক্তির মাপকাঠিতে ক্রিকেট ধারাভাষ্যের বিচার হবে— এ আর কী এমন বিস্ময়ের?

কিন্তু, বিস্ময়ের উদ্রেক না করলেও ঘটনাটি একটি গভীরতর বিপদের সংকেত দেয়। ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল যে কোনও নাগরিক এই ঘটনাকে বুঝতে চাইবেন মূলত গেরুয়া রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা সংকীর্ণ কিন্তু উচ্চকিত জাতীয়তাবাদের নিরিখে। এর সঙ্গে হয়তো বা তিনি জুড়ে নেবেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের মতো বিষয়কেও।

কিন্তু এই সবকে অতিক্রম করে ভারতীয় সত্তা এবং নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত আর একটি প্রশ্ন রয়ে যায়, যার প্রেক্ষিত বৃহত্তর এবং গুরুত্ব অসীম। মূল বিতর্কটি অপরের (ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা দেশ) প্রশংসা করা নিয়ে; বিশেষত সেই অপর যখন আমার (ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা দেশ) প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু অন্যের প্রশংসা করতে না চাওয়ার মধ্যে যে দীনতা রয়েছে সেটি কি ভারতবর্ষের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যে সনাতন ভারতবর্ষের দোহাই দিয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের রাজনীতির দাপট আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান, সেই ভারতবর্ষ কি এই দীনতাকে মান্যতা দেয়?

বৃহদারণ্যক উপনিষদে রয়েছে যাজ্ঞবল্ক্য এবং গার্গীর তর্কযুদ্ধের কথা। প্রাজ্ঞজনের সভায় যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে সমর্থ হন। মনে কোনও রকম অসূয়া পোষণ না করে গার্গী প্রতিদ্বন্দ্বীর শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে উপস্থিত পণ্ডিতজনের সামনেই তাঁর প্রশংসা করেন। আরও প্রসারিত, আরও উদার দর্শনের সন্ধান রয়েছে পতঞ্জলির যোগসূত্রে। সেখানে দেওয়া হয়েছে ‘মুদিতা’-এর ধারণা। যখন হৃদয় অন্যের সুখ, শ্রীবৃদ্ধি কিংবা আত্মিক উন্নতিতে সুখ অনুভব করে, অন্তরের সেই ভাব হল মুদিতা। এই একই ধারণা বৌদ্ধধর্মের চার গুরুত্বপূর্ণ ‘ব্রহ্মবিহার’ বা আধ্যাত্মিক দশার অন্যতম বলে পরিগণিত হয়। আর শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, নিজের সঙ্গে অভিন্ন তুলনা করে সর্বভূতের সুখদুঃখকে নিজের সুখদুঃখ বলে অনুভব করার কথা। যে ভারতবর্ষের হৃদয় থেকে উত্থিত হয় এই প্রসারিত ঔদার্য, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রশংসা অতি স্বাভাবিক আচরণ হিসাবেই বিবেচিত হওয়ার কথা। অথচ আজকের ভারতবর্ষে
চেষ্টা চলছে তার উল্টো পথে হাঁটার। উল্টো পথে হাঁটার ‘ছোট’ ‘বড়’ অজস্র চিহ্ন ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ পরিচালিত সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং কর্মকাণ্ডে।

রবীন্দ্রনাথ ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারী’তে বলেছেন, “যে-ব্যক্তি ছোটো তারও স্বধর্ম বলে একটি সম্পদ আছে। তার সেই ছোটো কৌটোটির মধ্যেই সেই স্বধর্মের সম্পদটিকে রক্ষা করে সে পরিত্রাণ পায়।” এই কথাটি দেশ এবং জাতির ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। স্বভাব ও স্বধর্ম থেকে বিচ্যুতি ব্যক্তি এবং জাতির জীবনে নিয়ে আসে বিপর্যয়। ভারতবর্ষের স্বধর্ম তার ঔদার্যে, বহুর মধ্যে নিগূঢ় যোগের সন্ধানে। ভারতবর্ষের চরিত্রে সঙ্কীর্ণতার কোনও ঠাঁই নেই। অথচ দেশভক্তির অজুহাতে আজ তারই উপাসনার আয়োজন চলছে দেশে। উত্তরপ্রদেশের দাদরি, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, ক্রিকেট ধারাভাষ্যের কিউবিক্‌ল— সব যেন আজ মিলে যায় ভারতবর্ষের স্বধর্ম থেকে এই বিচ্যুতির সম্ভাবনায়। বড় বিপজ্জনক সেই সম্ভাবনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE