Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

বেশ করব, লিখব

সহনশক্তি না বাড়ালে সভ্যতা কিন্তু দাঁড়াবে নাফেসবুক ইত্যাদিতে নাকি বাক্‌স্বাধীনতার নবযুগ শুরু হয়েছে। সকলে কেমন সকলের কথা বলতে পারছে, সকলের কথাই কেমন সমান শ্রবণযোগ্য, সকলের কথাই কেমন যত দূর ইচ্ছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ফেসবুক ইত্যাদিতে নাকি বাক্‌স্বাধীনতার নবযুগ শুরু হয়েছে। সকলে কেমন সকলের কথা বলতে পারছে, সকলের কথাই কেমন সমান শ্রবণযোগ্য, সকলের কথাই কেমন যত দূর ইচ্ছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। প্রবল গণতন্ত্রের প্রকাশ, যাকে বলে। কিন্তু এই গত ক’দিনে একটা কুরে কুরে খাওয়া সন্দেহ পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ‘প্রকাশ’টা আর যার-ই হোক, ‘গণতন্ত্র’-এর নয়। কেননা, সোশ্যাল মিডিয়াই আবার বুঝিয়ে দিচ্ছে, নিজের কথাটা বলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, অন্যের কথাটা যে করে হোক না-শোনা। অন্যের কথা বন্ধ করতে না পারলেও তুড়ি মেরে সেটাকে উড়িয়ে দেওয়া। হুমকি দেওয়া, গালাগাল করা। তেমন তেমন হলে, এফআইআর বা জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা তো আছেই।

সোশ্যাল মিডিয়া নেহাতই একটা আয়না। যে আয়নায় দেখতে পাই, বাক্‌স্বাধীনতার বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধির নাম করে সেই স্বাধীনতার উপর কী ভয়ঙ্কর আক্রমণের তরবারি এই সমাজে নেমে আসছে।

এই এক তরুণ কবি, সমাজসচেতন, দ্রুত চলমান কবিমন। মানুষের হেন দুর্গতি নেই, যা নিয়ে কবিতা তৈরি হয় না। যে কবিতা নিয়ে এত আবেগবিস্ফোরণ, সেটি ভাল না মন্দ, তা তাই একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক এইটুকুই যে একটি কবিতা লেখার পর কবিতার প্রেক্ষিতটা কী, তা নিয়ে এক বিন্দু না ভেবে কেবল বিচ্ছিন্ন দু’একটি শব্দ নিয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। প্রতিবাদী কবিতা, কিন্তু কীসের প্রতিবাদ তা না ভেবেই ‘এত প্রতিবাদ কেন’ প্রশ্ন খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে।

কোনও প্রতিবাদী, তিনি কবি বা লেখক হোন, কিংবা না-লেখক হোন, কখন প্রতিবাদ করবেন, সেটা কি তাঁর নিজের আত্মপ্রকাশের অধিকার নয়? এ ক্ষেত্রে কবি না-হয় বার বার ধারালো কলমে সব রকমের মৌলবাদ ও অসহন বিষয়ে ঘৃণা ও যন্ত্রণা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তা যদি না-ই হত? যদি কেউ অনেক কিছু সহ্য করতে করতে এক দিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার জায়গায় আসতেন? ‘তখন বলিনি তাই এখনও বলব না’ বলে বাধ্যত চুপ করে থাকতেই হত তাঁকে? এ কি সত্যিই কোনও যুক্তি হতে পারে যে প্রতিবাদ যখন আগে হয়নি, এখন প্রতিবাদ করার অর্থ নিশ্চয়ই ঘোর দুরভিসন্ধি? আর তেমন কোনও কুযুক্তি যদি থাকেই, প্রতিবাদী কি তবে সেই কুযুক্তির ভয়েই আত্মনিগড়ে বাঁধবেন নিজেকে? কবি ভাববেন, থাক বাবা এটা লিখব না, চলচ্চিত্র পরিচালক ভাববেন, থাক বাবা, এ কাহিনি দেখাব না, ইতিহাস বা সমাজতত্ত্বের গবেষক ভাববেন, থাক বাবা এ ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব না। এর থেকে বেশি অসহিষ্ণুতা, এর থেকে বেশি আত্ম-নিষেধাজ্ঞা (সেলফ-সেন্সরশিপ) আর কী হতে পারে? অথচ হইচই করে আজ আমরা এই সেন্সরশিপ-এর পক্ষেই ভোট দিচ্ছি? মুক্তমনারাও?

এই সমালোচক মুক্তমনারা বলবেন, ধর্মের পরিসরটা অন্য রকম, বড্ড সংবেদনশীল, আমাদের মতো বিরাট সংখ্যাগুরুর দেশে, সংখ্যালঘু-বিরোধিতা যেখানে রমরমে রাজনীতি সেখানে আরওই ভেবেচিন্তে পা (কলম?) ফেলা উচিত। কথাটা শুনে মনে হয়, সংবেদনটা কোথায় যে শুরু কোথায় শেষ, ঠিক ধরতে পারব তো আমরা? আজ ত্রিশূল নিয়ে সংবেদন, যে ত্রিশূল কেবল তেত্রিশ কোটি দেবতার এক জনের হাতের অস্ত্র, কাল যদি খাঁড়া কিংবা ইঁদুর নিয়েও সংবেদন হয়? কোথায় থামতে হবে, জানব তো ঠিক? উনিশশো চল্লিশের দশকের বাংলায় ‘গৈরিক পতাকা’ বলে একটি নাটক হয়েছিল শিবাজি ও মরাঠা পরাক্রম নিয়ে, বহু বাঙালি মুসলিম তাতে প্রবল ক্ষুব্ধ সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু শিবাজি ও মরাঠা ইতিহাস তো এ দেশের ইতিহাসের মধ্যেই পড়ে? তাঁরা যদি মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে থাকেন, তাতে ইসলামের অপমান ধরে নিয়ে এই ঐতিহাসিক নাটক নিষিদ্ধ হবে? আনন্দবাজার পত্রিকা সে দিন দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিল অন্তহীন এই ‘শুচিবায়ুগ্রস্ততা’ নিয়ে, বলেছিল, সহনশক্তি না বাড়ালে সভ্যতা কিন্তু দাঁড়াবে না। আজ সেই একই কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শুনবে কি কেউ? রক্ষণশীলদের কথা বাদই দিলাম, লিবারেলরাও কি মানবেন? না, সতর্কতার অজুহাতে লক্ষ্মণরেখার সওয়াল করবেন?

এই কিছু কাল আগে ফ্রান্সের ‘শার্লি এবদো’ বিতর্কের সময় সলমন রুশদি চমৎকার একটা শব্দ বানিয়েছিলেন: ‘বাট ব্রিগেড’। বলেছিলেন ‘আমি বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু তবু ভাবা দরকার...’ এই যুক্তি শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত, ধ্বস্ত। যাঁরা ধর্মের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই ‘কিন্তু’ তুলে ধর্মের ‘ভাবাবেগ’ আহত হওয়ার প্রসঙ্গে চলে যান, ধর্মের নামে কিছু বললে উল্টো বিপদ হতে পারে এই যুক্তিতে চলে যান, তাঁরা আসলে বাক্‌স্বাধীনতা আটকানোতেই জোর জোগান শেষ পর্যন্ত! আজও কবির বিরুদ্ধে এফআইআর-এর খবর শুনে যাঁরা বলছেন, ভাবাবেগে আঘাত দিলে তো এফআইআর হতেই পারে, কিন্তু তবু গলা খুলে এফআইআর-এর মধ্যে যে নিষেধাজ্ঞা জারির চেষ্টা, তাকে সমালোচনা করছেন না, তাঁরা, হয়তো অজান্তেই, সেন্সরশিপ-এর প্রতি সমর্থন এগিয়ে দিচ্ছেন। ভুলে যাচ্ছেন যে, কোনও যুক্তিতেই মুক্ত কথাবার্তার পরিসরটা ছোট করা যায় না। কবিকে যদি লেখার সময় প্রতিটি শব্দ ভাবাবেগে আঘাত করছে কি না দেখে নিতে হয়, তবে সমাজ আর মুক্ত, গণতান্ত্রিক থাকে না।

মুক্ত সমাজের কাজই হল নিষেধাজ্ঞার ‘লাল লাইন’টা যথাসম্ভব পিছন দিকে ঠেলে সরানো। যে সমাজ এ কাজটা যত ভাল পারবে, তার মধ্যে ততটাই মুক্তি। হিন্দুত্ববাদীদের সংখ্যা বাড়ছে, তাই আমি ত্রিশূল নিয়ে কোনও কথা বলব না, কিংবা ইসলামি মৌলবাদীদের দাপট বাড়ছে তাই আমি শরিয়তের পরতে পরতে অন্যায়ের কথা মুখেও তুলব না, এই ভাবে যাঁরা ভাবেন, বিপদ এড়াতে গিয়ে তাঁরা বিপদটাকে আরও ঘাড়ের কাছে নিয়ে আসেন। লাল লাইনটাকে একেবারে নাক অবধি টেনে আনেন। হিন্দুত্ববাদী বা ইসলামি মৌলবাদীদের খেলায় নিজেরাও অজান্তে খেলোয়াড় হয়ে যান।

আর সমানে লাল লাইন টানতে টানতে আমরা ভুলে যাই যে ধর্ম-সমাজটা আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত এক সুরে বাঁধা নয়। তাতে নানা সুর, নানা স্বর। কেউ ভাবে, আমি আমার ধর্মে থাকব, অন্যে অন্যের ধর্মে। কেউ ভাবে, আমি আমার ধর্মে থাকব এবং অন্যকে তার ধর্মে থাকতে দেব না। কেউ ভাবে আমার ধর্ম থাক না থাক, অন্যের ধর্মের বারোটা বাজাবই। এই সব ক’জনকে এক দলে ফেলা অসম্ভব। যে যোগী বলেন, অন্য ধর্মের মৃত নারীদের ধর্ষণ করে বোঝাও তুমি নিজে কত ধার্মিক, তাঁর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার অর্থ কি গোটা ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা? যে কবি বলেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের হুমকি দিলে ধর্ষককে শাস্তি দেব, তাঁর লক্ষ্য কি ধর্মবিরোধিতা না ধর্মান্ধতা-বিরোধিতা? ধর্ম আর ধর্মান্ধতা কি আলাদা নয়, বিশেষত ভারতের ইতিহাসে? হিন্দু ধর্মের প্রতি যে আবেগ, হিন্দুত্ববাদী গুন্ডাদের প্রতিও সেই একই আবেগ? ধার্মিক হিন্দুরা নিজেরা কেন এগিয়ে এসে বলছেন না যে তাঁদের ঐতিহ্য বলে ‘জীবে প্রেম’-এর কথা, বলে ‘যত মত তত পথ’, বলে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’, ত্রিশূলের উপরেও?

আর একটা ছোট্ট কথা। নিজের ‘ভাবাবেগ’-এর কথা বলতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যান, অন্যেরও ভাবাবেগ আছে। ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার প্রতীকে দূষণ ঘটলে রাগ-বিরক্তি হতে পারে। কিন্তু দেবতার বদলে মানুষকেই যাঁরা ‘ধর্ম’ ভাবেন, তাঁদেরও একটা ‘ভাবাবেগ’ আছে। নারীনির্যাতনের ধর্মবিলাস দেখে তাঁদেরও যন্ত্রণায় শরীর-মন অবশ হয়ে যায়, হয়তো কলম ধরে তাঁরা একটু বেশিই উগ্র হয়ে পড়েন। কবির বিতর্কিত শব্দবন্ধে অনেকে হুমকি আর রাগ দেখছেন, কিন্তু একটু অন্য ভাবে দেখলে ওর মধ্যে একটা গভীর যন্ত্রণাও কি টের পাওয়া যায় না? এটা তো মানতে হবে যে যোগীর ধর্ষণ-হুমকি শুনে যেমন সভার সহস্র লোক উল্লাসে ফেটে পড়ে, কবির কথা শুনে তেমন কেউ উল্লাস করে না। তবু যোগীদের সহ্য করব, কবিদের করব না?

ধর্ম না মানার অধিকারটাও কিন্তু একটা অধিকার। ধর্ম, অ-ধর্ম, অল্প-ধর্ম, সবই এই ভারতের সাগরতীরে ছিল, আছে, থাকবে। এই সব নিয়েই চলতে হবে। এই ‘বাক্‌স্বাধীনতা’র যুগেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE