বঙ্গে ইংরাজি নূতন বৎসর আসিল যথাযথ বেলেল্লাপনায় সওয়ার হইয়া। ২৫ ডিসেম্বর হইতেই পুলিশ সতর্ক থাকে, কলিকাতার পার্ক স্ট্রিটে এই বুঝি অসভ্য যুবকেরা মহিলাদের শারীরিক নিগ্রহ করিতে শুরু করিল, অশ্লীল কটূক্তির বন্যা বহাইয়া দিল। এই বুঝি দুই দল যুবকের মধ্যে হাতাহাতি বাধিয়া যাইল, কেহ গুরুতর আহত হইল। তাহারই দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় বর্ষশেষের রাত্রিতে। অবশ্য কেবল এই নির্দিষ্ট রাস্তায় নহে, বহু পথেই দেখা যায় মদ খাইয়া সম্পূর্ণ বেসামাল তরুণেরা হয় পথে বা অন্য লোকের গৃহের সম্মুখে সশব্দে বমন করিতেছে, বা প্রবল হল্লা করিতেছে, বা মারামারিতে রত হইয়াছে, অথবা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অসভ্য আচরণ বা কথার দ্বারা মহিলাদের বিরক্তি উৎপাদন করিতেছে। অনেকেই বেপরোয়া গতিতে বাইক চালাইতেছে, অবশ্যই হেলমেট না পরিয়া, কারণ নিয়ম মানিলে পৌরুষের হানি ঘটে, নিজেকে ভীরু বলিয়া বিজ্ঞাপিত করা হয়। বর্ষশেষের রাতে, ঘড়িতে বারোটা বাজিতেই, হাইওয়ের মাঝখানে অকস্মাৎ এক দল যুবক বাজি পোড়ানো শুরু করিল। অসংখ্য লরি ও কিছু গাড়ি মুহূর্তে থামিয়া যাইল। যত ক্ষণ উল্লাস চলিল, চালক ও আরোহীরা নিজ আসনে বসিয়া বিরক্তি চাপিয়া মোবাইল খুলিয়া নতমুখে ভিডিয়ো দেখিলেন, কারণ নবীন, কাঁচা ও পুচ্ছটি উচ্চে তুলিয়া নাচাইয়া অভ্যস্ত এই ব্যক্তিবর্গকে বাধা দিতে যাইলে, পরিণাম সুখের হয় না। এক সময়ে বঙ্গসমাজে মদ্যপান করাকে অত্যন্ত পাপকর্ম বলিয়া ধরা হইত। সেই ধারণায় বদ্ধতা রহিয়াছে অবশ্যই, কিন্তু যে কোনও উৎসব পালন করিতে হইলে আগে আকণ্ঠ মদ গিলিয়া লইতেই হইবে, নচেৎ সপ্রতিভতায় টান পড়িবে, ইহার মধ্যেও কম বদ্ধতা নাই। তদুপরি, মদ খাইয়া যদি নিজ আচরণের প্রতি নিয়ন্ত্রণ না রাখা যায়, উদ্দাম অসংবৃত ব্যবহারই নিয়ম হইয়া দাঁড়ায়, তবে সামাজিক অশিষ্টতা বাড়িবেই। আর, কোনও জনসমষ্টির অন্তর্গত যুবসমাজ যদি নিরন্তর অসভ্যতাকেই দৃপ্ত ও সাহসী আচরণ বলিয়া ঠাহরাইয়া লয়, সেই সমাজ অতিশয় দুর্ভাগা।
দত্তপুকুরে বর্ষবরণের রাতে স্ত্রীকে বাড়িতে রাখিয়া বাহিরে যাইয়াছিলেন স্বামী, চার মত্ত যুবক ঘরের দরজা ভাঙিয়া ঘরে ঢুকিয়া মহিলাকে ধর্ষণ করিল। যুবকদের বাধা দিতে যাইয়া গাল খাইলেন ও প্রহৃত হইলেন বাড়ির প্রৌঢ় মালিক। লেক টাউন ও শ্রীভূমির মাঝে বর্ষবরণ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলিতেছিল, বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারও সেখানে ছিলেন। কিন্তু রাত বারোটার পরেই এক দল যুবক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, বাজি ফাটাইবার সময়ে অভব্য আচরণ করে, অন্য এক দল যুবকের সহিত তাহাদের ব্যাপক গন্ডগোল বাধিয়া যায়। বড়তলায় এক যুবক নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া স্কুটার হইতে পড়িয়া যান ও পিছন হইতে একটি লরি তাঁহাকে ধাক্কা মারে। রক্তাক্ত সেই যুবককে ফেলিয়া চম্পট দেয় তাঁহার সঙ্গীরা। হয়তো তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে লইয়া যাইলে তিনি বাঁচিয়া যাইতেন। উল্লাসসঙ্গী হইলেই প্রকৃত বন্ধু হওয়া যায় না, তাহার পরিচয় পাইয়া স্তম্ভিত পুলিশ ও যুবকের আত্মীয়েরা। নীতিকথায় ভল্লুকের সম্মুখে বন্ধুকে ফেলিয়া বৃক্ষে চড়িয়া পড়িয়াছিল এক সঙ্গী। এই আমোদের রাতেও বহু সঙ্গীই কেবল ব্যসনে পার্শ্বে অাছে, দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে ও দুর্ঘটনায় নাই। অবশ্য বন্ধুত্ব পালনও সহজ কথা নহে। বেলুড়ে রাতে পিকনিক চলিতেছিল, খবর পাওয়া যায় অনতিদূরেই পাড়ারই এক ছেলেকে অনেক ছেলে মিলিয়া পিটাইতেছে। উদ্ধার করিবার জন্য ছুটিয়া যান প্রহৃত ছেলের এক বন্ধু ও সেই বন্ধুর মামা। প্রথমে ছেলেগুলি মামাকে পিটাইতে শুরু করে, তাঁহাকে বুকে পাথর দিয়া অাঘাত করিতে তিনি জ্ঞান হারান। তাঁহাকে বাঁচাইতে ভাগিনেয় অগ্রসর হইলে, তাঁহাকে বাঁশ ও ইট দিয়া আঘাত করা হয়, তিনি লুটাইয়া পড়িতে, কংক্রিটের চাঙড় দিয়া মাথা থেঁতলাইয়া দেওয়া হয়।
কী চমৎকার আমাদের এই উৎসব, যাহা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলকে এক হইয়া হর্ষের অধিকার দেয় ও অধিকাংশকেই মানবিক গুণগুলি পরিহার করিয়া জান্তব তামাশায় রত হইতে প্রণোদিত করে। মদ খাইয়া বা না খাইয়া বাংলা কি তাহা হইলে এমন পুলকাঞ্চলে পরিণত হইতেছে, যেখানে আহ্লাদের অজুহাতে সকল নখ ও দন্তগুলি বাহির করিয়া আনিয়া, সহ-মানুষকে যথাসম্ভব নিগ্রহ ও অত্যাচার করা চলে? প্রতি পদে অসামাজিকতার, এমনকি সমাজবিরোধিতার স্বাক্ষর রাখা যায়? মানবসমাজে উৎসব প্রচলনের উদ্দেশ্য ছিল বিপরীত, কিন্তু বাংলা সত্যই এই ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র ভাবনার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছে!
যৎকিঞ্চিত
মৃত মানুষের নামেও পুলিশের নোটিস এল উত্তরপ্রদেশে। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক নন। ঠিকই তো, মারা গেলেই লোকে নিরীহ হয়ে যান না। এক মৃত কবির কবিতা নিয়ে অাইআইটি কানপুর আলোড়িত। কবিতাটি হিন্দুবিরোধী না স্বৈরাচার-বিরোধী: প্রবল তর্ক। সিএএ, এনআরসি-র সমর্থক ও বিরোধীরা দু’লাইন অন্তর মৃত নেতা বা লেখককে টেনে আনছেন। কাল রবীন্দ্রনাথের নামে পরোয়ানা জারি হলে, পুলিশের প্ল্যানচেট বিরাট ব্রেকিং নিউজ়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy