সাম্প্রতিক গবেষণা জানাইল, সুইটজ়ারল্যান্ড বা জাপানের মানুষের তুলনায় ভারতের মানুষেরা কম বয়সে বৃদ্ধ হইয়া পড়েন। গবেষকরা হিসাব করিতেছিলেন, গড়ে কোনও ৬৫ বৎসরের মানুষ যে বয়সজনিত অসুস্থতাগুলিতে ভুগিবেন, সেইগুলিতে কোন দেশের কত বয়সের মানুষ ভুগিতেছেন। দেখা যাইল, জাপান বা সুইটজ়ারল্যান্ডে সাধারণত ৭৬ বৎসর বয়স্ক ব্যক্তি সেইগুলিতে ভুগিয়া থাকেন, আর পাপুয়া নিউগিনিতে ৪৬ বৎসর বয়স্ক ব্যক্তি। ভারতে ৬০ বৎসরের পূর্বেই সেই অসুখগুলি ঘিরিয়া ধরে। এই ফলগুলি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইহাতে বুঝা যায়, একটি দেশের জনগণ কেন অধিক উৎপাদনে সক্ষম হইতেছে না, বা অপেক্ষাকৃত দ্রুত অবসর লইতে চাহিতেছে, শারীরিক কারণে ব্যয়ই বা কেন অধিক হইতেছে। যে দেশে এক ৫০ বৎসর বয়স্ক ব্যক্তি হাঁটিতে-চলিতে ৭০ বৎসরের ন্যায় দুর্বল বোধ করিবেন, সেই দেশে কর্মশক্তি কম হইবে, ইহাতে আশ্চর্য কী! ভারতে মানুষ যে দ্রুত বুড়া হয়, তাহা শারীরিক আঁক কষিয়া কী পরিমাণে স্পষ্ট হইবে, তাহা বিজ্ঞানীরা বুঝিবেন, কিন্তু এই দেশের মানুষের মানসিকতা যে প্রবীণতার দিকে সতত ঢলিয়া আছে, তাহা বুঝিতে কোনও বিশদ গবেষণার প্রয়োজন নাই।
এক সময়ে বলা হইত, এই দেশের মহিলারা ‘কুড়িতেই বুড়ি’, কিন্তু ইহাতেও সন্দেহ নাই যে এই দেশের পুরুষেরাও বিশেই বিষাক্ত। যতই কবি প্রার্থনা করুন, কোনও নবীন বা কাঁচা আসিয়া আধমরাদিগকে ঘা মারিয়া বাঁচাইতে মোটেই উদ্গ্রীব নহে, বরং নিজ কাঁচামো পরিহার করিয়া তাহারা আধমরাদের ন্যায় কঠিন গাম্ভীর্য আয়ত্ত করিয়া প্রথাবদ্ধ ঘাড় নাড়াইতে পারিলে বাঁচে। এই দেশের কর্মশক্তি গ্রাস করিতে দেহের বিভিন্ন গ্রন্থিতে ব্যথার ভূমিকা প্রচুর, কিন্তু তদপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মানসিক জড়তার। কিছু দিন পূর্বেই একটি কাপড় কাচিবার সাবানের বিজ্ঞাপন লইয়া হুলস্থূল পড়িয়া যাইল। দেখানো হইয়াছিল, একটি হিন্দু বালিকা হোলির দিন আবাসনের অন্যান্য বালকবালিকা নিক্ষিপ্ত বেলুন ও পিচকারির রং নিজ গাত্রে লইয়া লইল, তাহার পর সেই জোগানগুলি তখনকার মতো ফুরাইলে, ধবধবে শুভ্র পোশাক পরা একটি মুসলিম বালককে ডাকিয়া, তাহাকে সাইকেলের পিছনে চড়াইয়া, মসজিদে পৌঁছাইয়া দিল, যাহাতে তাহার সাদা কাপড়ে রঙ না লাগে। ছেলেটি বলিল, নমাজ পড়িয়া আসিতেছি, মেয়েটি বলিল, তাহার পর তোমায় রং দিব। দিব্য মিষ্ট একটি বিজ্ঞাপন, বন্ধুত্বের কথা বলে, যে দাগ সবার রঙে রং মিলাইতে মানুষকে প্রণোদিত করে, সেই দাগ ভাল— এই কথাও বলে। অকস্মাৎ দেখা যাইল, সমাজমাধ্যমে প্রবল বিক্ষোভ: বিজ্ঞাপনটি নাকি হিন্দুত্বকে অপমান করিয়াছে, এইটি ‘লাভ জেহাদ’-এর পক্ষপাতী, এইখানে হিন্দু নারী ও মুসলিম পুরুষের প্রীতিসম্বন্ধ দেখানো হইয়াছে।
প্রথমত, বিজ্ঞাপনে নিতান্ত বালকবালিকাদের দেখানো হইয়াছে, কেন সাধারণ বন্ধুত্বকে হঠাৎ প্রণয় বলিয়া পড়া হইল তাহা বিস্ময়কর। তাহার পর চমক জাগে এই আপত্তির মূল সুরটি বুঝিয়া: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইহাদের মতে আপত্তিকর আবেগ! অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সম-মানুষের ন্যায় ব্যবহার ইহাদের মতে এক বিকৃত কাণ্ড! আর, কোনও মুসলিম পুরুষের সহিত কোনও হিন্দু নারীর ঘনিষ্ঠতা ও প্রেম যদি একটি চলচ্চিত্রে দেখানোও হয়, বা সাহিত্যে বিবৃত হয়, তাহাতে ক্ষতিই বা কী? কিন্তু সমাজমাধ্যমের মস্তানেরা অহরহ নেতিবাচক ঢক্কানিনাদের লীলা প্রস্তুত করিতেছেন, সহজ সুস্থ যুক্তিবুদ্ধি উড়াইয়া তাঁহারা বর্বর-রাজত্ব কায়েম করিবেন। এমন আপত্তিও শুনা গিয়াছে, হোলি খেলার তুলনায় নমাজ পড়া গুরুত্বপূর্ণ হইল কিসে? প্রথমত, কী কাহার নিকট গুরুত্বপূর্ণ হইবে, তাহা সেই ব্যক্তি বুঝিবে। দ্বিতীয়ত, নমাজ পড়িয়া ছেলেটি হোলিতে যোগ দিবে, তাহাও বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট। বিজ্ঞাপনটি বলে, সকলেই প্রত্যেকের উৎসব ও আচার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল থাকিলে, একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমরা বাস করিতে পারিব। সম্ভবত এইখানেই আপত্তি। অন্যকে বক্ষে টানিতে যে প্রাণশক্তি লাগে, সেইখানেই অভাব। দিনের পর দিন এই দেশ যেন ঔদার্য, সহিষ্ণুতা ত্যাগ করিয়া অন্ধতা ও আড়ষ্টতার দিকে পতিত হইতেছে। যেন এক অশক্ত জনপিণ্ড লোল দন্তহীন মুখে হিংস্র দংশনেচ্ছা লইয়া তাকাইয়া রহিয়াছে। কোনও বর্ণময় বসন্তোৎসব আসিয়া ইহাদের নীরক্ত মৃতকল্প ঘৃণাজর্জর সত্তাকে শুদ্ধ করিতে পারিবে না।
যৎকিঞ্চৎ
মালয়েশিয়া যাচ্ছিল প্লেনটা, কিন্তু অচিরে সৌদি আরবে ফিরে আসতে বাধ্য হল, কারণ এক যাত্রী এয়ারপোর্টে তাঁর বাচ্চাকে ফেলে এসেছিলেন। বাক্সপ্যাঁটরা নিতে তো লোকে রাতদিন ভুলে যাচ্ছে, পাসপোর্ট বা অ্যাডমিট কার্ড ফেলে আসছে বাথরুমে পার্কে রেস্তরাঁয়, কিন্তু বাচ্চা? শিশুটি বড় হয়ে জেনে নিশ্চয়ই অভিমানের চোটে কেঁদেকেটে একাকার করবে, কিংবা কে বলতে পারে, বৃদ্ধ বাপ বা মা’কে ভুলে ফেলে আসবে কুম্ভমেলায়, আর মনে মনে বলবে, ‘শোধ, ১-১!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy