আমরা যারা এই আকালেও... স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সামনে জেএনইউ-এর ছাত্ররা। দিল্লি, অক্টোবর। পিটিআই।
কর্ণ জোহর কি নজিব আহমদকে চেনেন? তিনি আপাতত যে মুশকিলে পড়েছেন, তাতে জেএনইউ থেকে উধাও হয়ে যাওয়া ২৭ বছরের ছাত্রটির খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁ-র নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেটি উধাও হয়ে যাওয়ার আগের দিনই ফোন করেছিল বাড়িতে। ভীত গলায় জানিয়েছিল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের এক বাহুবলী তাকে ভয়ানক শাসিয়েছে। তার পর থেকেই নজিব উধাও। ঠিক যখন থেকে কর্ণ জোহরের সিনেমায় পাকিস্তানি অভিনেতা থাকা নিয়ে বিপুল অশান্তি, তখন থেকেই নজিবেরও খোঁজ নেই।
পরস্পরকে চিনে রাখতে পারতেন তাঁরা। মহম্মদ আখলাক, এম এম কলবুর্গিকেও। নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে, নাগপুরের পথনির্দেশে যে নতুন ভারত তৈরি হচ্ছে, নজিব-কর্ণ-কলবুর্গি-আখলাক সেই নির্মাণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন যে। মধ্যযুগে মন্দির তৈরি করার আগে ভিতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। মোদীরা এখন সেকেন্ডে ২০০২ মাইল বেগে মধ্যযুগে ফিরছেন। নজিব-কর্ণ-কলবুর্গি-আখলাকরা সেই ভারতের ভিতে বলিপ্রদত্ত।
সে ভারত কেমন, এত দিনে তা স্পষ্ট। শুধু হিন্দুত্ববাদী নয়, মনুবাদী, এক-সাংস্কৃতিক, অসহিষ্ণু, পুরুষতান্ত্রিক। মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর যেমন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। নেহরুর উত্তরাধিকার অস্বীকার করে নরেন্দ্র মোদীরা এমন ভারতই তৈরি করতে চাইবেন। সংসদে প্রবেশ করার সময় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন বটে মোদী, কিন্তু তার আগে, সঙ্ঘের পাঠশালায় খাকি হাফপ্যান্ট পরে কুচকাওয়াজ করতে করতে তাঁরা গণতন্ত্রের পাঠ পাননি, বহুত্ববাদের গুরুত্ব বুঝতে শেখেননি। গোলওয়ালকরের নাৎজি-ভক্তি ছিল তুলনাহীন। তাঁর আদর্শগত সন্ততি যে একনায়ক হতে চাইবেন, সামরিক শক্তিকে ঠাঁই দেবেন নাগরিক সমাজের ঊর্ধ্বে, যে কোনও বিরুদ্ধ স্বরকেই দেগে দিতে চাইবেন অবৈধ বলে, তাতে অস্বাভাবিকতার ছিটেফোঁটাও নেই।
কিন্তু, এই চাওয়াগুলোকে বাস্তবায়িত করতে হলে আগে তার লেজিটিমেসি— বৈধতা— প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আর, সেই বৈধতা দিতে পারে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষ। কাশ্মীরে শিশু-কিশোরদের ওপর ছররা বন্দুক চালিয়ে তাদের অন্ধ করে দিতে পারে রাষ্ট্র। কিন্তু, সেই অন্ধত্ব তাদের প্রাপ্যই ছিল, এই কথাটা শুধু রাষ্ট্র বললেই হয় না, কথাটা গোটা মানুষকে দিয়ে বলিয়ে নিতে হয়। হিন্দি ছবির প্রযোজকের কবজি মুচড়ে টাকা আদায় করতেই পারেন হিন্দু হৃদয়সম্রাটের উত্তরাধিকারীরা— বস্তুত, তাঁরা করেই থাকেন— কিন্তু সেটা যে নিছক গুন্ডামি নয়, বরং নির্জলা রাষ্ট্রভক্তি, এই স্বীকৃতি সাধারণ মানুষের থেকে আদায় করিয়ে নিতে হয়। এই স্বীকৃতি না পেলে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি মাপের নেতার পক্ষেও কাজগুলো চালিয়ে যাওয়া কঠিন, কারণ এখনও তাঁকে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাশ নম্বরের কথা ভাবতে হয়। ২০১৫ সালে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারা হলে ২০১৯-এর ভোটে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, এই হিসেব কষে যেতে হয় নিরন্তর।
রিপাবলিকের পাবলিক এখানেই তাঁদের আশ্বস্ত করেছে।
আজ নজিব আহমদের বেমালুম উধাও হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের নিস্পৃহ নিষ্ক্রিয়তায় কারও কিচ্ছু যায় আসে না। বরং, ক্যাম্পাসের ছাত্ররা কেন তদন্তের দাবিতে উপাচার্যকে ঘেরাও করে রাখছে, কেন ধর্না দিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সামনে, তা নিয়ে বিরক্ত হচ্ছেন অনেকেই। অস্বাভাবিক? আসলে নয়। কারণ, জেএনইউ বা যাদবপুর বা এফটিআইআই, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররা অনেক আগেই পাবলিকের চোখে বৈধতা হারিয়েছে। কানহাইয়া কুমার, উমর খলিদরা যখন আফজল গুরুর ফাঁসি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এবং প্রত্যুত্তরে রাষ্ট্র যখন তাঁদের দাগিয়ে দিয়েছিল দেশদ্রোহী বলে; যাদবপুরে যখন ছাত্ররা ‘বুদ্ধ ইন আ ট্র্যাফিক জ্যাম’ প্রদর্শনের প্রতিবাদে ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যায়’ দেখাতে চেয়েছিল; এফটিআইআই যখন গজেন্দ্র চৌহানকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল, সেই মুহূর্তগুলোই এই প্রতিষ্ঠানগুলির বৈধতা হারানোর সময়। ঘটনাগুলো আলাদা, আবার একও। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ছাত্ররা প্রশ্ন করেছিল রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রের ভাবনাকে, দখলদারিকে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম সাধারণ মানুষ এতখানি রাষ্ট্রভক্ত হয়ে উঠেছে— এখন রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা অবৈধ।
সেই অবৈধ প্রতিষ্ঠান থেকে যদি একটি ছাত্র হারিয়ে যায়, রাষ্ট্রের কী দায় তাকে খুঁজে বের করার? কী দায় তদন্ত করে দেখার, মুসলমান ছেলেটিকে কতখানি ভয় দেখিয়েছিল এবিভিপি-র দাদা? মুসলমান বলেই দায় আরও কম নয় কি? গরু খাওয়ার অপরাধে মহম্মদ আখলাককে যখন পিটিয়ে মেরেছিল হিন্দুত্বের পাহারাদাররা, অথবা দেশ জুড়ে যখন গোরক্ষা সমিতি দাপিয়ে বে়ড়ায়, তখন প্রধানমন্ত্রীর কুলুপ আঁটা মুখও যে ভারতের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে রাগাতে পারে না, তার মধ্যেও বৈধতা-অবৈধতার গল্পটা চোখে পড়ার মতো। মুসলমানরা যেহেতু শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই হিন্দুরাষ্ট্রের ‘অপর’— গুরুজি গোলওয়ালকর যাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের বেশি কিছু ভাবতে রাজি হননি— অতএব তারা কোনও কারণে রাষ্ট্রের নিয়ম ভাঙলে সেই অপরাধ অক্ষমণীয়। গোহত্যা তেমনই অপরাধ। এবং, এক বার অপরাধী সাব্যস্ত হলে এই ভারতে কারও আর ন্যায়বিচারের অধিকার থাকে না। তার সঙ্গে রাষ্ট্র যে আচরণই করে, সেটাই বৈধ। অতএব, নজিবকে খুঁজতে পুলিশ গা না করলেও সেই গড়িমসি বৈধ। কাল রাজনাথ সিংহ বা যোগী আদিত্যনাথ বা অন্য কেউ তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দিলে, সেটাও বৈধ। নজিবকে, নজিবদের, বিশ্বাস করার দায় ভারতের নেই।
আফজল গুরুর ফাঁসিকে প্রশ্ন করা আর গোমাংস ভক্ষণ, কাশ্মীরে সেনার হাতে বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের ক্ষোভ উগরে দেওয়া আর এক সুদর্শন পাকিস্তানি অভিনেতাকে সিনেমায় নেওয়া— এমন বহুমুখী ঘটনাক্রমকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলতে কতখানি রাজনৈতিক চাতুর্যের প্রয়োজন হয়, ভাবলে অবাক লাগে। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে সেই সুতোর নাম জাতীয়তাবাদ। গোলওয়ালকরের জাতীয়তাবাদ, যেখানে পাকিস্তানকে পাল্টা দেওয়াই জাতির একমাত্র কাজ। শুধু সীমান্তের ওপারে থাকা পাকিস্তান নয়— ভারতের ভৌগোলিক পরিসরেও যা-ই (হিন্দু)রাষ্ট্রের পরিপন্থী, তা-ই পাকিস্তান। বিজেপির মেজো-সেজো নেতারা যেমন মুসলমানদের নিয়মিত পাকিস্তানে যাওয়ার সুপরামর্শ দিয়ে থাকেন। কাশ্মীরের মাটি ভারতের, কিন্তু মানুষ পাকিস্তানি, কারণ তারা ভারতীয় সেনার দিকে পাথর ছোড়ে। যারা আফজল গুরুর ফাঁসিকে প্রশ্ন করে, তারা দেশদ্রোহী, যারা ফওয়াদ খানকে সিনেমায় নেয়, তারাও।
রাষ্ট্র যেটুকুকে দেশ বলে চিহ্নিত করে দেয়, নাগপুরের রাজনৈতিক দর্শন যে ভাবে জাতির গণ্ডি টানে, ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ সেই সংজ্ঞাকেই শিরোধার্য করেছে। কেন, সেই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া অসম্ভব। ভারত যত দিন নেহরুর উত্তরাধিকার বহন করেছিল, তত দিন যে সাম্প্রদায়িকতা, যে মুসলমান-বিদ্বেষ শিক্ষিত জনসমাজ নিজেদের মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হত, এখন তার কমলদল খুলেছে বলে? না কি, সেনাবাহিনীর পেশি-আস্ফালনের মধ্যে যে ‘পৌরুষ’ রয়েছে, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির মতোই ভারতীয়রা তার আকর্ষণেও ধরা দিয়েছে? না কি, গণতন্ত্রের ‘বাড়াবাড়ি’-তে বিরক্ত মধ্যবিত্ত সব প্রতিরোধের ওপর রোলার চালিয়ে উন্নয়নের রাস্তা তৈরি করতে চায়? যে কারণেই হোক, ভারতের নাগরিক সমাজ এখন এই জাতীয়তাবাদের কষ্টিপাথরে বৈধতার বিচার করে। সেই বিচারের রায় কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। রাষ্ট্র যাকে জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী বলে দাগিয়ে দেয়, তা-ই যদি অবৈধ হয়, তবে রাষ্ট্র তার সঙ্গে যে আচরণই করুক না কেন, সেই আচরণের বৈধতা প্রশ্নাতীত। ছররা চালিয়ে কাউকে অন্ধ করে দেওয়াও বৈধ, গরুচালানের অভিযোগে পিটিয়ে মারাও বৈধ, সিনেমার মুক্তিপণ হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা আদায় করাও বৈধ। গণদেবতার এমন প্রসন্ন মুখ খুব কম রাজনীতিকই দেখার সুযোগ পান।
তবু কি সেই গণদেবতার মনেও সংশয় হয় না? সেই সংশয় কাটানোরও চমৎকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়েছে। সুচতুর ভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনতার উচ্চাবচ সম্পর্ক। সেখানে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের বাহুবল নয়, বরং দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ রক্ষাকর্তা। নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, সেনারা আমাদের পাহারা দিচ্ছে বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি— কিন্তু সেই ঘুম যদি না ভাঙে, আমরা যদি সেনাবাহিনীর পাশে না থাকি, তবে সেনারা আমাদের ক্ষমা করবেন না। আমরাও জেনেছি, সেনাকে যারা আক্রমণ করে, তারা আমাদের শত্রু— কাশ্মীরের ক্ষুব্ধ জনতা আমাদের শত্রু। মুসলমান-নিধন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে মধ্যবিত্ত ভারতীয় চটজলদি শুনিয়ে দিয়েছে, সিয়াচেনের অমানুষিক ঠান্ডায় যে সেনাকর্মীরা মারা যান, তাঁদের জন্য তো কই এই ‘সিকুলার’দের শোক উথলে ওঠে না। ফওয়াদ খানকে নিয়ে কর্ণ জোহরের হেনস্থা নিয়ে কথা বললে উত্তর এসেছে, যে দেশের সন্ত্রাসবাদীরা উরিতে আমাদের সৈন্যদের মেরে যায়, সেই দেশের অভিনেতাকে নিয়ে এত কথা কীসের? ভক্তির জোর প্রশ্নাতীত। দেশভক্তির জোরও। ফলে, যেখানে প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে কেন সিয়াচেনে পাহারা দিতে যাওয়া সৈনিকদের জন্য রাষ্ট্র যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে পারে না, কেন পাঠানকোটের পরও উরিতে আক্রমণ হতে পারে আর উরির পর শ্রীনগরে সিআরপিএফ-এর কনভয়ে— সেখানে ভারতের পাবলিক রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতাকেই রাষ্ট্রের আচরণের বৈধতার যুক্তি করে তুলেছে। মোদীর কপালজোর, না কি রাজনৈতিক চতুরতার প্রমাণ?
নরেন্দ্র মোদীরা যে ভারত তৈরি করছেন, তার কথা ভাবলে ভয় করে। আরও ভয় করে সেই ভারতের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের কথা ভাবলে, যাদের কাছে রাষ্ট্রের যে কোনও আচরণই বৈধ, স্বাভাবিক। তবে, একটাই ভরসা— মোদীর ভারতে যে ভারতীয়দের কণ্ঠস্বর দুর্দম, তারা আসলে সংখ্যালঘু। ভারতের ৩৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের আনাচেকানাচে যাঁরা আছেন, কোনও স্যোশাল মিডিয়া যাঁদের ছুঁতে পারেনি এখনও, টিভির ইংরেজিভাষী অ্যাঙ্কর যাঁদের জাতীয়তাবোধ তৈরি করে দেন না, অথচ ভোটের দিন যাঁরা প্রত্যেকে শহুরে উচ্চকিত ভোটারদের সমান অধিকারী— তাঁরাও নরেন্দ্র মোদীর জাতীয়তাবাদের শরিক হবেন তো? না কি, নরেন্দ্র মোদী এখনও গণদেবতার মন্দিরে পৌঁছতেই পারেননি? এই অন্তঃসারশূন্য জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে সেই মন্দিরে পৌঁছনো যায় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy