Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিরিয়ার উলুখাগড়ারা

অন্য দিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন সিরিয়া থেকে সরে আসতে, কিন্তু ট্রাম্পের পারিষদরা ভিন্ন মত।

শমন: মৃত্যু-পরোয়ানা নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাচ্ছে সিরিয়ার আকাশে। ১০ মে। ছবি: রয়টার্স

শমন: মৃত্যু-পরোয়ানা নিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাচ্ছে সিরিয়ার আকাশে। ১০ মে। ছবি: রয়টার্স

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ০০:০৭
Share: Save:

এখন সিরিয়া জঙ্গি-কবল থেকে অনেকটাই মুক্ত। কিন্তু কিছু জায়গায় এখনও তাদের ঘাঁটি আছে, এবং প্রভাব আছে বৃহত্তর এলাকায়। তাদের নির্মূল করে পুরো সিরিয়ার দখল ফিরে পেতে চান প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদ। অভিযোগ, সেই লক্ষ্যেই গত ৭ এপ্রিলের রাসায়নিক হানা। তার জবাবে আমেরিকা ও বাকি বিশ্বের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আরও তীব্র আক্রমণ হবে বলে ভেবেছিলেন আসাদ। যেটুকু হয়েছে, তাতে তাঁর আত্মবিশ্বাসে ততটা টোল পড়েনি। আর আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন যতটা রাসায়নিক অস্ত্র নষ্ট করার দাবি করছে, সম্ভবত ততটা হয়নি। আসাদ যে ফের রাসায়নিক আক্রমণ করবেন না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আর, রাসায়নিক অস্ত্র বাদ দিলেও তাঁর সামরিক শক্তি বিপুল। তার উপরে পাশে আছে ইরান এবং রাশিয়া। মসনদে ফিরে আসা পুতিনের রাশিয়া।

অন্য দিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন সিরিয়া থেকে সরে আসতে, কিন্তু ট্রাম্পের পারিষদরা ভিন্ন মত। মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড-এর সেনাপতি জেনারেল জোসেফ ভোটেল ও আইএস-বিরোধী অভিযানের প্রধান ব্রেট ম্যাকগার্ক বলেছেন, ‘‘যদিও সিরিয়ার বেশির ভাগ অঞ্চল থেকে আইএস জঙ্গিরা সরে গিয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় তারা ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। সেখান থেকে তাদের উৎখাত করাটা জরুরি। আর, আমেরিকা সরে গেলে জঙ্গিরা যে ফের দখল নেওয়ার চেষ্টা করবে না, তেমন কোনও ভরসা নেই। এখন প্রয়োজন অঞ্চলটিতে স্থায়িত্ব আনা। সামরিক সাহায্য দেওয়া তাই খুবই প্রয়োজন।’’ প্রাক্তন মার্কিন বিদেশ সচিব রেক্স টিলারসনও জানুয়ারি মাসে জানিয়েছিলেন যে, পূর্বতন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরাক ও লিবিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়ার ফলে ওই দু’টি দেশকে জঙ্গি-সন্ত্রাস নতুন করে গ্রাস করেছিল, সেই ভুল তাঁরা আর করতে চান না।

কূটনীতির বিচারেও আমেরিকার পক্ষে সরে আসা কঠিন। কারণ, তা হলেই ওই অঞ্চলে ইরানের প্রাধান্য বাড়বে, যা আমেরিকা মোটেই চায় না। সেটা চায় না আমেরিকার দোসর ইজ়রায়েল এবং মিত্র সৌদি আরবও, ইরানের সঙ্গে যাদের দীর্ঘমেয়াদি টক্কর। তা ছাড়া, আসাদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগে সিরিয়ায় এবং পশ্চিম এশিয়ায় রাশিয়ার প্রতিপত্তি বেড়েছে, ক্রমশ আরও বাড়বে। সুতরাং ট্রাম্প যতই চান যে তিনি ‘ঢের হয়েছে’ বলে সিরিয়া থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেবেন, আমেরিকার স্বার্থেই সেটি করা যাবে না।

বিশেষ করে এখন, ইরান চুক্তি থেকে আমেরিকার বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরে। ট্রাম্পের এই এক সিদ্ধান্ত গোটা পশ্চিম এশিয়ার হিসেবনিকেশ লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। তাঁর ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিরিয়ায় ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাত বাড়ছে। প্রথমে সিরিয়ার ইজ়রায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটস এলাকায় ইরানের আক্রমণ, তার জবাবে সিরিয়ায় ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে ইজ়রায়েলি হানা। এর পর কী? তটস্থ দুনিয়ার নানা দেশ। ফ্রান্স-জার্মানি ইরানকে বলেছে প্রত্যাঘাত না করতে। রাশিয়া ইরান ও ইজ়রায়েল দু’পক্ষকেই সংযত থাকতে বলেছে।

এই মুহূর্তে ইরানের সংযমের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষত সিরিয়ার ভবিষ্যৎ। গোটা অঞ্চলে ইরানের প্রতিপত্তি কম নয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সঙ্গে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইরাকের সংখ্যাগুরু শিয়া গোষ্ঠীর ওপরে ইরানের প্রভাব বিস্তর। ইয়েমেন-এর সৌদি-ঘনিষ্ঠ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জঙ্গিগোষ্ঠী হুথিকে মদত দেয় ইরান। চুক্তি বাতিলের ঠিক পরেই এই হুথি গোষ্ঠী অনেকগুলি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। লেবাননে হেজ়বোল্লা গোষ্ঠী চিরকালই ইরানের সাহায্যপুষ্ট, তারাও হুমকি দিয়েছে সিরিয়ায় ইজ়রায়েলি আক্রমণের জবাব দেবে। সুতরাং, ইরানের সংযমের বাঁধ ভাঙলে কী হবে, আঁচ করা যায়। ট্রাম্পের ঠেলায় সে দেশে কট্টরপন্থীদের এখন বাড়বাড়ন্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং সংযম কত দিন টিকবে বলা কঠিন।

আসাদের চিন্তা বাড়ছে। তাঁর প্রধান সমস্যা দুটো জায়গা নিয়ে। দুটোই সীমান্তের কাছে। দক্ষিণে, যেখানে আপাতত যুদ্ধ স্থগিত, সেখান থেকে জঙ্গিদের উৎখাত করতে হলে রাশিয়া ও ইরানের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে হবে। কিন্তু সিরিয়ায় ইরানের প্রতিপত্তি যদি আরও বাড়ে, তা হলে ইজ়রায়েলের পক্ষে সেটা দুঃসহ হয়ে উঠতে পারে, তারা গোলান হাইটস পার হয়ে সরাসরি সিরিয়ায় আক্রমণও করতে পারে। এখন ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আসাদ চাইবেন না।

অন্য দিকে, সিরিয়ার উত্তরে ইদলিব-এর অবস্থা আরও সঙ্কটাপন্ন। এখানে পুরো অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে জঙ্গিরা। তাদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী হল হায়াত তাহির আল-শাম। রাশিয়া এবং সিরিয়া দু’পক্ষই চায় এদের ধ্বংস করতে। কিন্তু এই অঞ্চলটিতে প্রায় ২০ লাখ লোকের বাস। এখানে যদি জঙ্গি গোষ্ঠীকে সরাতে যুদ্ধ বাধে, তা হলে একটা মানবিক বিপর্যয় হবে। এমনটা আশঙ্কা করে সতর্ক করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশেষজ্ঞরাও। তা ছাড়া, এখানে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রেখেছে কুর্দরা। আসাদ যদি এখন এই অঞ্চলের নিরঙ্কুশ দখল চান, তা হলে কুর্দদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে হবে তাঁকে। সেটাও তিনি এখন না চাইতে পারেন। এই মুহূর্তে হয়তো কুর্দরাও সিরিয়া সেনার সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে এই এলাকার বেশ কিছুটা অঞ্চল সিরিয়াকে ছেড়ে দিতে পারে। রাশিয়াও এখন তুরস্কের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে এই অঞ্চলে যুদ্ধ থামাতে চাইছে। কিন্তু এই শান্তি নিতান্ত ভঙ্গুর। তার প্রমাণ মিলেছে। ইদলিবে আসাদের যুদ্ধবিমানের আক্রমণে এক পরিবারের ৯ জন মারা গিয়েছেন, যার মধ্যে ৫টি শিশু। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে একটি ‘নিরাপদ স্থান’-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইদলিবে, গোটা সিরিয়াতেই, নিরাপদ স্থান বলে কিছু নেই। সব কিছু সব সময়েই অনিশ্চিত।

অনিশ্চয়তা যত বাড়বে, কূটনীতির খেলা দিনে দিনে ততই আরও জটিল হবে। এতগুলো দেশের সম্পর্কের সমীকরণগুলো কিছুতেই মিলতে চাইছে না, মিলবেও না। পরিণতি কী হবে জানা নেই। আসাদও জানেন না, আমেরিকাও জানে না। কেবল বোঝা যাচ্ছে, ধ্বংস আর ধ্বংসের শঙ্কায় দিন কাটাবেন সিরিয়ার মানুষ। বহু ধ্বংস পেরিয়েও তাঁরা আরও বড় ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং করবেন। সিরিয়ার বহু মানুষ মরে যাওয়ার পরেও আরও বহু মানুষ বেঁচে আছেন এখনও, মারা যাওয়ার জন্য, অসীম দুরবস্থা ভোগ করার জন্য। যুদ্ধ এবং কূটনীতির দাঁড়িপাল্লার খেলা ঘটমান বর্তমান। এবং ঘটমান বর্তমানই থাকবে।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Missile Syria militancy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE