Advertisement
০১ জুন ২০২৪

একটি ধর্মঘটের বর্ষপূর্তি

ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পেরেছেন যে মেয়েরা, তাঁরা কিন্তু দৈনন্দিন কর্মজীবনে লড়াই করে চলেছেন নানা বিপন্নতার সঙ্গে।

সুপ্রিয়া রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ১৩:১৭
Share: Save:

বেঙ্গালুরুতে রেডিমেড বস্ত্র শিল্পে ধর্মঘটের বর্ষপূর্তি হল গত এপ্রিলে। বিশ্বের বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে এই শিল্প। সেই বস্ত্র শিল্পে এই ধর্মঘটকে একটা মোড়-ঘোরানো ঘটনা বলে মনে করা হয়। এই শিল্পের শ্রমিকরা প্রধানত মহিলা। অদক্ষ, স্বল্পশিক্ষিত, গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে আসা মেয়েরাই রেডিমেড বস্ত্র শিল্পে কাজ করেন বেশি। তাঁরাই প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন বদলের প্রস্তাব রুখে দিয়েছিলেন। প্রস্তাবিত প্রভিডেন্ট ফান্ড আইনে (২০১৬) বলা হয়েছিল যে ৫৮ বছর বয়সের আগে পি এফ থেকে টাকা তুলতে পারবে না কর্মীরা। এই মেয়েদের কাছে সেটা ছিল ভয়ানক প্রস্তাব। এঁদের ন্যূনতম মজুরি মাসে সাত হাজার টাকা। অনেকে সংসারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য, কারও কারও স্বামী অদক্ষ শ্রমিক, তারও রোজগার সামান্য। চিকিৎসা, সন্তানের পড়াশোনা, সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডই ভরসা। আইন বদল হলে সে টাকায় হাত দেওয়া যাবে না, খবরটা বেঙ্গালুরুর বস্ত্র শিল্পে ছড়িয়ে পড়তেই ছোট ছোট জটলা, মিটিং শুরু হল। দ্রুত তা পরিণত হল বিশাল আন্দোলনে। বড় বড় মিছিল বেঙ্গালুরুর প্রধান রাস্তাগুলি আটকে দু’দিন শহর অচল করে রাখল। শেষে প্রস্তাব ফিরিয়ে নিল কেন্দ্রের সরকার। সংগঠিত শ্রমিক প্রতিবাদ সফল হল।

মনে হতে পারে, প্রভিডেন্ট ফান্ড রয়েছে ক’জনের? ভারতে শ্রমিকদের ৯৪ শতাংশই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তা ঠিক, কিন্তু যাঁদের তা রয়েছে, তাঁদের সংখ্যাও তিন কোটি ষাট লক্ষ। অনেকেরই আপৎকালীন প্রয়োজনে পিএফই একমাত্র ভরসা। সে দিক থেকে দেখলে বেঙ্গালুরুর শ্রমিকদের ধর্মঘট দেশের মাস-মাইনের কর্মীদের একটা বড় অংশের জীবনকে স্পর্শ করেছে। যাঁদের একটা বড় অংশই চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত।

এত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পেরেছেন যে মেয়েরা, তাঁরা কিন্তু দৈনন্দিন কর্মজীবনে লড়াই করে চলেছেন নানা বিপন্নতার সঙ্গে। অন্যান্য সংগঠিত শিল্পের মতো রেডিমেড বস্ত্র শিল্পেও ন্যূনতম মজুরি, ইএসআই, প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধে রয়েছে ঠিকই। কিন্তু কিছু বিষয়ে এই শিল্পের চরিত্র অংসগঠিত ক্ষেত্রের মতো। ন্যূনতম মজুরি পায় না অনেকে, ওভারটাইমের জন্য বাড়তি টাকা নেই, ছাঁটাই সহজ, কারখানায় নানা জবরদস্তি চলে। মহিলা শ্রমিকরাও চট করে একটা কারখানা থেকে অন্যটায় চলে যান, বা গৃহপরিচারিকার কাজে আসেন, ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন। চার লক্ষ কর্মীর মাত্র ছয়-সাত হাজার ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। সংগঠিত ভাবে দরদস্তুর করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে।

তাই রেডিমেড বস্ত্র শিল্পের মেয়েদের ধর্মঘটকে শ্রমিক আন্দোলনের সাফল্যের নজির বলে দাবি করার আগে কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার। এক, বস্ত্র উৎপাদক সংস্থাগুলি কারখানার গেটের মধ্যে কোনও রকম ইউনিয়নের কাজ হতে দেয় না। এই শিল্পে ইউনিয়নের নেতাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল কর্মীদের সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথা বলার সময় এবং জায়গা নির্দিষ্ট করা।

দুই, এই শিল্পের বৃহত্তম ইউনিয়নটি (গারমেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন) ধর্মঘটকে আন্দোলনের ঠিক পদ্ধতি বলে মনে করে না, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়। এই শিল্পের শ্রমিকরাও কিন্তু এমন মাঝামাঝি অবস্থান পছন্দ করেন। এঁরা অধিকাংশই মহিলা, প্রথম প্রজন্মের কারখানা শ্রমিক, গ্রাম থেকে শহরে এসেছে কাজ করতে। নিয়মিত কাজ ও প্রতি মাসে বেতন, এই নিশ্চয়তা এদের প্রধান চাহিদা। যা কাজ ও রোজগার ব্যাহত করতে পারে, তা তাঁরা এড়িয়ে যায়।

তিন, ইউনিয়নের আন্দোলনের ফলে ন্যূনতম মজুরির বৃদ্ধি ঘটেছে ঠিকই। কিন্তু পাঁচ জনে এক জন মজুর এখনও ন্যূনতম মজুরি পান না। তাঁরা এক কথায় ছাঁটাই হয়ে যান, অতিরিক্ত উৎপাদনের লক্ষ্য চাপানো হয় তাঁদের উপরে। গালিগালাজ সহ্য করে, যৌন হয়রানির শিকার হয়ে কাজ করতে হয় এই মেয়েদের।

গত এপ্রিলে মেয়েরা যে ভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন, তা এক দিকে বোঝায় যে সংঘর্ষের রাজনীতির মাধ্যমে চাপ তৈরি করতে তাংরা প্রস্তুত। কিন্তু সেই আন্দোলন সাফল্য পেলেও আরও বড় কোনও আন্দোলনের পথ তৈরি করল না। বাড়তি পারিশ্রমিক, কাজের উন্নত পরিবেশ বা অন্যান্য চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ নিলেন না ওই মেয়েরা।

কেন? হয়তো এই কারণে যে, দেশের প্রায় সব শহরের মতো বেঙ্গালুরুতেও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা কমে আসছে। ভারতের শহরগুলিতে উৎপাদন শিল্পের ক্ষেত্রে (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) শ্রমিক গড়ে ২৪ শতাংশ। বেঙ্গালুরুতে তা ২১ শতাংশ। যেখানে পরিষেবা ক্ষেত্র নিয়োগ করছে ৭৩ শতাংশ শ্রমিককে। এর ফলে শ্রমিক রাজনীতির স্থান ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। শ্রমিকদের মধ্যে অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান, সর্বজনীন সমস্যার উপলব্ধি, পরস্পর সহযোগিতা ও নানা শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে জোটবদ্ধতা, এবং সেই সঙ্গে শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা, এর কোনওটাই তাই সম্ভব হচ্ছে না।

লেখক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনমিক চেঞ্জ, বেঙ্গালুরু-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ready-made clothing industry Bangalore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE