প্রতীকী চিত্র।
অন্ধকার রাত্রির গায়ে তারার ন্যায় ফুটিয়া রহিয়াছে লক্ষ কোটি প্রদীপের প্রজ্বলিত দীপশিখা। ভারতের সর্বত্র। নেপালেও। বস্তুত, দুনিয়ার যে প্রান্তে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ পৌঁছাইয়াছে, সেইখানেই। দূর হইতে দেখিলে বোধ হইবে, যেন এক অভিন্ন উৎসব চলিতেছে। নিছক দৃষ্টিবিভ্রম। হিন্দু বাঙালি যখন উদ্যাপন করিতেছে কালীপূজা, উত্তর ভারতের হিন্দুদের নিকট তখন উদ্যাপন চৌদ্দ বৎসর বনবাস শেষে রামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের— দেওয়ালির। শিখ সম্প্রদায় সেই দিনটিই তাহাদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দের মুক্তির উৎসব পালন করে, জৈন সম্প্রদায়ের নিকট তাহা শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তির দিন। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে যে দিনটি কৃষ্ণের নরকাসুর নিধনের উদ্যাপন, হিমালয়ের কোলে নেপালে তাহাই তিহর, লক্ষ্মীপূজার মাধ্যমে দসেইন-এর সমাপ্তি। সর্বত্রই রাতের আকাশ প্রদীপের আলোয় আলোকময়— অধুনা অবশ্য এলইডি আলো আসিয়া প্রদীপের কম্পমান শিখাকে লইয়া গিয়াছে— কিন্তু, সেই আলো কেন জ্বলিতেছে, তাহার কারণটি সম্প্রদায়বিশেষে ভিন্ন। দেওয়ালি নামক একশৈলিক ধারণায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে ধরা যাইবে না; এমনকি প্রদীপের ক্ষীণ আলোতেও ধরা পড়িয়া যাইবে যে, এই উৎসব সব হিন্দুর নিকটও এক নহে। নাগপুরের ধ্বজাধারীরা এই সরল সত্যটি বুঝিবেন, তেমন আশা নাই। কিন্তু বৃহত্তর ভারতকে বুঝিতে হইবে, এই বিভিন্নতার নামই ভারতবর্ষ। যেখানে আপাত ঐক্যের মধ্যে নিহিত থাকে ভিন্ন স্বর, আবার ভিন্নতার মাটিতেই বহিয়া চলে একতার ধারা। এই ভারতকে ক্ষুদ্র সংজ্ঞায় বাঁধিবে, সেই সাধ্য কাহার?
নেপালের ঘরে যিনি তিহর উপলক্ষে প্রদীপ জ্বালাইতেছেন, পাসপোর্টের পরিচিতিতে তিনি নেপালি, জাতিগত পরিচিতিতেও নেপালিই, ধর্মীয় পরিচিতিতে হিন্দু। অথচ, হিন্দু হইলেও যে উৎসবটি তিনি পালন করিতেছেন, তাহা উত্তর ভারতের হিন্দুর দীপাবলি নহে। আবার, ধর্মীয় পরিচিতিতে পৃথক হইলেও এই বিশেষ দিনটিতেই জৈন বা শিখ পরিবারের অঙ্গনেও জ্বলিয়া উঠিতেছে প্রদীপ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু যে দেবীর আরাধনা উপলক্ষে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালিতেছেন, সেই দেবীর এই বিশেষ রূপটি বহুলাংশে বাংলারই। এখানেই পরিচিতির বহুত্বের অমোঘ গুরুত্ব। পরিচিতির যে সূত্রটি ভিন্ন, তাহা যে পরিচিতির অভিন্ন সূত্রকে ঢাকিয়া দেয় না, বরং ভিন্নতাকে স্বীকার করিয়াও অভিন্নের উৎসবে মাতিতে পারে, এই কথাটি মানুষ তাহার স্বাভাবিক জীবনচর্যার নিয়মেই জানে। কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিন আলোর উৎসবে মাতিতে হইলে কোনও একটি বিশেষ ধর্মের অন্তর্গত হইতে হয় না, কোনও একটি বিশেষ জাতিপরিচয়কেও স্বীকার করিয়া লইতে হয় না। এই সহজিয়া বোধটিই ভারত নামক অসম্ভব ধারণাটিকে বাস্তবায়িত করিতে পারিয়াছিল। সঙ্কীর্ণতার রাজনীতি এই বোধটিকেই গুলাইয়া দিতে চাহে: কোনও একটি বিশেষ পরিচিতিতে অন্য পরিচিতির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়া বহুত্বের মধ্যে বিরোধ পাকাইয়া তোলে। অমর্ত্য সেন হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড-এ লিখিয়াছেন, ১৯৩০-এর দশকে যাঁহারা ‘বাঙালি’ ছিলেন, ১৯৪০-এর দশকে রাজনীতি তাঁহাদের করিয়া তুলিল সংঘাতোন্মুখ হিন্দু বা রণং দেহী মুসলমান। ইহাই রাজনীতি খেলা। দীপাবলির আলোয় এই খেলাটির স্বরূপ দেখিয়া লওয়া প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy