Advertisement
২০ মে ২০২৪
Anti-Defection Law

চলাচল

শিশির অধিকারী এখনও তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ, অথচ নির্বাচনী প্রচারের মধ্যলগ্নেই তিনি বিজেপির মঞ্চে সেই দলের পতাকা হাতে তুলিয়া লইয়াছিলেন।

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২১ ০৪:৫৫
Share: Save:

এক দলের হইয়া ভোটে জিতিবার পরে জনপ্রতিনিধি হিসাবে স্বাক্ষরের কালি শুকাইতে না শুকাইতে বিপরীত দলে যোগদানের এমন তৎপরতা দেখিয়া পশ্চিমবঙ্গবাসী অতীতে কাতর হইতেন, এখন বিস্তরে পাথর হইয়াছেন। বুঝিয়াছেন, রাজনৈতিক আদর্শ এখন পদ্মপাতায় জলের ন্যায়— অতিশয়চপলম্। কিন্তু তাহার পরেও কথা থাকিয়া যায়। আদর্শের কথা নহে, হিসাবের কথা। বিধানসভায় মুকুলবাবুর অবস্থানটি এখন কী দাঁড়াইবে? সাধারণ বুদ্ধি বলে— ব্যক্তিগত মত বহুরূপীর মতো বদলাইতে পারে, তাহা ব্যক্তির অভিরুচি, কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে এমন দলবদল ভোটদাতার সহিত চুক্তি ভাঙিবার শামিল, সুতরাং তাঁহার অর্জিত আসনটি সঙ্গে সঙ্গেই চলিয়া যাওয়া বিধেয়। দুঃখের কথা, রাষ্ট্রচালনায় সাধারণ বুদ্ধির দৌড় বেশি নহে। ষাটের দশক হইতেই বিধায়ক ও সাংসদদের দলবদলের প্রবণতা বিস্তর সমস্যা ও বিতর্কের জন্ম দিয়াছে, আশির দশকে দলত্যাগ নিবারণী আইন আনা হইয়াছে, এই শতকের গোড়ায় তাহাতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আসিয়াছে, কিন্তু ঝঞ্ঝাটের অবসান হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় হইতে মানস ভুঁইয়া— এক দলের আসনে বসিয়া অন্য দলের রাজনীতি করিবার কাহিনি সর্বজনবিদিত। কলিকাতার মেয়র বা বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদকেও এই দ্বৈতসত্তার আবর্তে পড়িতে দেখা গিয়াছে। মুকুল রায়ের কাহিনিও সেই তালিকায় যুক্ত হইতে চলিয়াছে, এমন আশঙ্কা অমূলক নহে।

এই অনিশ্চয়তার প্রধান কারণ, বিধায়ক বা সাংসদ দলবদল করিলে এবং তাঁহার সদস্যপদ খারিজ করিবার দাবি উঠিলে কর্তব্য স্থির করিবার অধিকার প্রধানত সংশ্লিষ্ট আইনসভার পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকের হাতে, অর্থাৎ বিধানসভা বা লোকসভার ক্ষেত্রে স্পিকারের হাতে ন্যস্ত হইয়াছে। স্পিকারের সিদ্ধান্তের বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা অসম্ভব নহে, কিন্তু তিনি যতক্ষণ কোনও সিদ্ধান্ত না লইতেছেন, ততক্ষণ কার্যত স্থিতাবস্থাই জারি থাকে। সমস্যা এইখানেই। নানা ক্ষেত্রে দেখা গিয়াছে, দল-বদলানো জনপ্রতিনিধির সদস্যপদ বিষয়ে স্পিকার দীর্ঘদিন কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নাই। ফলে দ্বৈত পরিচিতির প্রকট অসঙ্গতি লইয়াই সেই সদস্যরা কাজ করিয়া গিয়াছেন। ইহা স্পষ্টতই অবাঞ্ছিত। সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও শ্রী কেবল আইনের পরিধিতে সীমিত নহে, ন্যায্যতার ভূমিকাও সেখানে প্রবল। সেই কারণেই রাজ্যের নাগরিক আশা করিবেন, মুকুল রায় বা অনুরূপ বিধায়কদের লইয়া সংশয় দীর্ঘায়িত হইবে না, দ্রুত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে।

বস্তুত, এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াইবার জন্য দলবদল সংক্রান্ত আইনটিতে হয়তো আরও সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার বিধান সংযোজন করা জরুরি, যাহাতে সদস্যপদ সংক্রান্ত বিতর্কের মীমাংসা কোনও ব্যক্তির হাতে না থাকে। অন্ততপক্ষে অভিযোগ উঠিবার পরে তাহার দ্রুত নিষ্পত্তির নিয়ম ও সময়সীমা আইনেই বলিয়া দেওয়া থাকে। ঠিক তেমনই, কোনও দলের বিধায়ক বা সাংসদদের ষথেষ্ট বড় অংশ— যেমন এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক— দল ত্যাগ করিলে তাহাকে দলের বিভাজন হিসাবে গণ্য করিবার নিয়মটিও আরও নিরপেক্ষ ও কার্যকর করিবার প্রয়োজন। রাজনীতিকরা অবশ্য এমন নিরপেক্ষতা ও নির্দিষ্টতা চাহিবেন বলিয়া ভরসা হয় না, জল ঘোলা থাকিলেই তাঁহাদের সুবিধা। বিজেপির রাজনীতিকরা যেমন মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিতেছেন। দিতেই পারেন। তবে অভিযোগকারীরা আপন ঘরের দিকে এক বার চাহিয়া লইলে ভাল করিবেন। শিশির অধিকারী এখনও তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ, অথচ নির্বাচনী প্রচারের মধ্যলগ্নেই তিনি বিজেপির মঞ্চে সেই দলের পতাকা হাতে তুলিয়া লইয়াছিলেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC Anti-Defection Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE