অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ না করার একটি প্রতিশব্দ রয়েছে— অবিমৃশ্যকারিতা। বৌবাজারের দুর্গা পিতুরি লেনে তিন বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি— অনেকগুলি বাড়ির দেওয়াল, মেঝে, এমনকি রাস্তায় ফাটল ফিরে আসার ঘটনার পরে কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে অবিমৃশ্যকারী বললে অত্যুক্তি হবে কি? ২০১৯-এর অগস্টে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে জলস্তর ভেঙে বৌবাজার অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি বসে যায়, বহু বাড়ি ধসে পড়ে বা গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাতারাতি অন্যত্র সরে যেতে হয়েছিল প্রায় সাতশো স্থানীয় বাসিন্দাকে, ছড়িয়েছিল আতঙ্ক, জীবনাশঙ্কা।
একই ভয় ফিরে এল ২০২২-এ। আবারও বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল, বাসিন্দাদের তড়িঘড়ি এক কাপড়ে ঘর ছাড়া, হোটেলে গিয়ে ওঠা। সেই একই দুশ্চিন্তা, ভয়। মাঝে অতিমারিপীড়িত দু’টি বছরে জীবন ও কাজকর্ম চরম বিঘ্নিত হয়েছে সত্য, কিন্তু মেট্রোর কাজ শুরু হতেই একই বিভ্রাটের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে, মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় বিরাট ফাঁক রয়ে গিয়েছে, অন্তত স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ভাবনায় তো বটেই। এখন দুর্ঘটনার পরে মেট্রোর কাজই বন্ধ হয়ে গেল, বর্ষার যুক্তি দেখিয়ে। কলকাতা পুরসভা মেট্রো কর্তৃপক্ষকেই দুষেছে, কিন্তু বৌবাজারে মেট্রোর কাজে যে এই বিপদ হতে পারে, তার কিছুমাত্র পূর্বভাবনা পুরসভার তরফেও দেখা যায়নি। অতিমারি পেরিয়ে এক দিন মেট্রোর সুড়ঙ্গের কাজ শেষ করতে হবে, অজানা ছিল না। বৌবাজার অঞ্চলের পুর-মানচিত্র, মেট্রোর কাজের জেরে সম্ভাব্য পুর-বিপদ বা জটিলতা পুরসভার না জানার কথা নয়। বিশেষত যেখানে তিন বছর আগে এক ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে, শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল তা থেকেও। মেট্রো কর্তৃপক্ষ এখন দেশি-বিদেশি সুড়ঙ্গ বিশারদের সাহায্য নিচ্ছে— পুরসভারও কি বৌবাজার এলাকার বিপদ অনুমান করে আগে থেকেই মেট্রো কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা বিধেয় ছিল না?
এই অবহেলা প্রকট হচ্ছে আজ, যখন জানা যাচ্ছে বিপন্ন বাড়িগুলি অতি প্রাচীন, বয়সভারে দুর্বল, স্বভাবত ক্ষতিপ্রবণ। দুর্ঘটনার পরে আজ অনেকগুলি বাড়িকে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ বলা হচ্ছে। এ কথা বলা উচিত ছিল অনেক আগেই, দরকার ছিল এ ধরনের বাড়ি মেরামত বা সংস্কারের, কিংবা সময়োচিত প্রয়োজন মেনে ভেঙে ফেলার। পুরসভা এর কোনওটিই করেনি। এ কাজে কোনও আগ্রহ দেখাননি বাড়িগুলির মালিকরাও, তার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ এ রাজ্যের ভাড়াটিয়া আইনও। আইনে যা-ই বলা থাক, বাস্তব চিত্রটি বলে: পুরনো বা প্রাচীন বাড়িগুলিতে দীর্ঘ কাল ধরে বসবাসরত ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করা দুরূহ বা প্রায় অসম্ভব এক কাজ, ভাড়া বাড়ানোও সহজ নয়। এই কারণেই মালিকেরা বাড়ির সংস্কারে কিছুমাত্র শ্রম সময় বা অর্থ ব্যয় করেন না। বৌবাজার এলাকার অনেক বাড়িই প্রাচীন, বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ার স্বার্থের দড়ি-টানাটানিতে ভুক্তভোগী, এবং সবচেয়ে বড় কথা— বিপন্ন ও বিপজ্জনক। আজ মেট্রোর কাজের জেরে দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সব অব্যবস্থাই বেরিয়ে পড়ছে। এক দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবিবেচনা, অন্য দিকে পুরনো আইনি সমস্যার জটিলতা, এই দুইয়ের খেসারত দিচ্ছে বৌবাজার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy