মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গে পুজো এলে ছুটির ঘোষণাও কি দূরে থাকতে পারে? মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ বার পুজোয় সরকারি অফিস-কাছারিতে এগারো দিন ছুটি। কিন্তু তারও আগে, পয়লা সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজাকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ তকমা দেওয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মিছিল হবে, ভরদুপুরে। মুখ্যমন্ত্রী পরিকল্পনা করে দিয়েছেন, রঙিন পোশাক পরে, বাঁশি-শাঁখ-ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা হবে; পথের ধারে চেয়ারও পাতা থাকবে, যাতে লোকে বসে সেই শোভাযাত্রা দেখতে পারে। মুশকিল হল, পয়লা তারিখ বৃহস্পতিবার, কাজের দিন। অফিস-কাছারি খোলা, স্কুলকলেজও। লোকজন যদি অফিসে কলম ঘষে, অথবা ছেলেমেয়েরা যদি ক্লাসঘরে বসে সতেরোর নামতা মুখস্থ করে, তা হলে মিছিলে হাঁটবে কে? মুখ্যমন্ত্রী ‘স্যাটাস্যাট’ সেই সমস্যারও সমাধান করে দিয়েছেন— ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন, সেই দিনটা একটার মধ্যেই অফিস বন্ধ করে দেওয়া হোক, স্কুলও ছুটি দিয়ে দেওয়া হোক, যাতে সবাই মিছিলে যেতে পারেন। খেয়াল রাখা ভাল যে, এটি পরামর্শমাত্র— গ্রীষ্মকালে গরম পড়েছিল বলে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়ার মতো হুকুম নয়। তবে কিনা, কিছু ক্ষেত্রে ফিসফিসানিও গর্জনের মতো শোনায়— ফলে ধরে নেওয়াই যায় যে, বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ ‘অর্ধদিবস বন্ধ থাকিবে’। এ রাজ্যে সম্বৎসরই ভরসাফুর্তি উৎসব চলে, কাজেই পুজোর ছুটির বরাদ্দ এগারো দিন থেকে বেড়ে সাড়ে এগারো দিন হয়েছে বলে চোখ কপালে তোলা নেহাতই বাড়াবাড়ি।
মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনা, কলকাতায় যে মিছিল হবে, তার দর্শক হিসাবে তিনি বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের, এবং শিল্পমহলকে নিমন্ত্রণ জানাবেন। কাজের দিন দুপুরবেলা তাঁরা এই অনাবিল আনন্দে যোগ দিতে রাজি হবেন কেন, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাকুক। কিন্তু, তাঁরা এসে দেখবেন কী? সেই রাজ্যের ছবি, যেখানে ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা’য় কাজের দিন দুপুরে অফিসের দায়িত্ব বাদ দিয়ে, লেখাপড়া বাদ দিয়ে সবাই আনন্দ করতে এসেছে? দূতাবাসের প্রতিনিধিরা নিজেদের দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে যখন পশ্চিমবঙ্গের এই বহুবর্ণ শারদ-উল্লাসের গল্প বলবেন, তখন এই কর্মসংস্কৃতির কথাও নিশ্চয়ই উল্লেখ করবেন। দেশি শিল্পমহলও নিজের চোখেই দেখে যাবে, কী ভাবে কাজের দিন দুপুরবেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র সম্পূর্ণ অচল হয়ে যেতে পারে, কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যাবতীয় অর্থপূর্ণ কাজ। এই রাজ্যে উৎসবের সংখ্যা যে শুধুই বেড়ে চলে, ফুর্তির কোনও শেষ নেই, এ সবও নিশ্চয়ই তাঁদের জানা। তার পরও পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা লগ্নি করবেন কি? আলবার্ট আইনস্টাইন একদা বলেছিলেন, ঈশ্বর জুয়া খেলেন না। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, শিল্পমহলও নিজেদের লগ্নি নিয়ে জুয়া খেলে না। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের হাতে থাকবে উৎসব, শিল্পের ছিপ এবং মাছ নিয়ে যাবে অন্য রাজ্য।
যে রাজ্যের শাসকরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বিষয়ে অতি সচেতন এবং সদা প্রচারোন্মুখ, সেই রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় পার্বণের জন্য এগারো দিন সমস্ত সরকারি দফতর বন্ধ রাখা কোন বার্তা বহন করে, সেই প্রশ্নটি কেউ করতে পারেন। অথবা জানতে চাইতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেই কি ইচ্ছামতো স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া যায়? শিক্ষা বিষয়টি শাসকদের চোখে গুরুত্বহীন, ভারতে আজ তা সংশয়াতীত রকম স্পষ্ট। কিন্তু তার পরও, খেয়ালখুশিমতো স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে প্রকট দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আছে, তা ভয়ঙ্কর। এবং, এই দুর্ভাগ্যলাঞ্ছিত ভারতেও তা তুলনাহীন। হীরকরাজা পাঠশালা বন্ধ করে দিতে পারতেন বটে, কিন্তু তাঁকেই আদর্শ জ্ঞান করা সমীচীন হবে কি না, মুখ্যমন্ত্রী সে কথাটি আরও এক বার বিবেচনা করলে ভাল করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy