বাংলায় বিয়ের মরসুম উপস্থিত। ফাইল চিত্র।
কার্তিক গড়াচ্ছে অঘ্রানের দিকে, সন্ধ্যার আকাশ রাঙা বালুচরির মতো, বাতাসে সুখাদ্যের সুঘ্রাণ। বাংলায় বিয়ের মরসুম উপস্থিত। পাড়ায় পাড়ায় কত না অলৌকিক সাজে সজ্জিত ভবন দৃষ্টিকে চমকে দিচ্ছে। ওই সব হল বিয়েবাড়ি। সুশোভন সাজে আগত নিমন্ত্রিতদের সানন্দ আপ্যায়ন, সৌজন্য বিনিময়, আনন্দভোজ, সকলকে সন্তুষ্ট করে আমন্ত্রণকর্তার পরিতৃপ্তির সন্ধান— কত প্রজন্ম বিয়েবাড়ির এই পালা চলছে, কে বলতে পারে? ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, আধুনিক রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক প্রাচীন বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি, রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানের চেয়েও প্রাচীন বিয়ের অনুষ্ঠান। সেই বহু পুরাতনের নব আবিষ্কার চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বাঙালি বিয়ের মেনুর পরিবর্তন তো প্রায় গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ফিশ ওরলি’-র ব্যুৎপত্তি জানতে চেয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কেমন বিপাকে ফেলেছিলেন কন্যাকর্তাকে, সে গল্প বইয়ের পাতা ডিঙিয়ে এখন অনলাইনেও ভাইরাল। আজ অবশ্য ফিশ ওরলি, ফিশ মাঞ্চুরিয়ান, ফিশ পঞ্জাবি— বাঙালির কাছে সবই জলভাত। রাশিয়ান স্যালাড থেকে কোরিয়ান কিমচি, বিয়েবাড়ির মেনু মানেই বিশ্ববাংলা। ‘দুয়ারে ফুচকাওয়ালা’ লোকসংস্কৃতির অম্লমধুর স্পর্শও দিচ্ছে। তেমনই বাড়ির সাজের ভোলবদল— উঠোনের চার দিকে বাঁশ-কাপড়ের দেওয়াল তুলে, ছাদে নড়বড়ে টেবিল পেতে খাওয়ার দিন গিয়েছে। এখন কোনও বাড়ির সজ্জা শান্তিনিকেতনি-ছাঁদে সুরুচির স্বাক্ষর রাখে, তো কোনওটা আলোর ছটায় তস্য গতিতেও অনুভূতি জাগায় লাস ভেগাসের হোটেলের লবির। অতীতের কিছু উত্তম জিনিস পড়ে গিয়েছে বাতিলের তালিকায়, যেমন নহবত। আবার পুরাতন আচারের পাষাণ ঠেলে জন্ম নিচ্ছে প্রত্যয়ী শিশুবৃক্ষ, যা নতুন অর্থ যোগ করছে বিবাহের অনুষ্ঠানকে।
যেমন, বাঙালি বিবাহ অনুষ্ঠানের সাবেক রীতিতে কন্যা কার্যত রেশমের পুঁটলিতে পর্যবসিত। এক পুরুষের দ্বারা আর এক পুরুষের হাতে মেয়েকে ‘সম্প্রদান’ করা কি একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মর্যাদার বিরোধী নয়? আজ তার বিকল্পের খোঁজ করছে বাংলার মেয়েরা— ধর্মাচরণে নৈতিক মূল্যবোধের খোঁজ না পেয়ে ধর্মীয় রীতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানকেই বর্জন করে। বিবাহ হল এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেও অনেকে আড়ম্বরপূর্ণ বিয়েকে বর্জন করেন— সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর মেয়ের বিয়েতে অতিথি আপ্যায়ন করেছিলেন মুড়ি-তেলেভাজা দিয়ে। অনেকে ধর্মকে অবলম্বন করেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে চান, কিন্তু এ-ও চান যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে যেন জীবনবোধের সংযোগ থাকে। উনিশ শতক যেমন অর্থহীন সংস্কারের বোঝা ছুড়ে ফেলতে ফিরেছিল ধর্মের মৌলিক গ্রন্থগুলিতে, তেমনই দেখা যাচ্ছে একবিংশেও। অনেক পুরোহিত, যাঁদের কেউ কেউ মহিলা— এগিয়ে এসেছেন বৈদিক মন্ত্রের বিবাহের আয়োজনে, যেখানে বধূও স্বয়ং বিবাহের নানা কাজে অংশগ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দু’পক্ষের বাবা-মাও। সাবেক ধারণা বাতিল করে কখনও বর-বধূ পরস্পরের ভালমন্দের দায়গ্রহণের অঙ্গীকার করে, কখনও বা মা সম্প্রদান করেন কন্যাকে। এতে বিবাহের মন্ত্র কিছু অর্থহীন শব্দোচ্চারণ হয়ে থাকে না, বিবাহের অনুষ্ঠানও প্রশ্নহীন নিয়মরক্ষায় আটকে থাকে না। এই তরুণ-তরুণীদের নাছোড় দাবিই বার বার ধর্মের সমাজধারণ-ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচিয়েছে।
তবু দিনের শেষে সব পাখি ফিরে আসে না ঘরে। বিবাহের অনুষ্ঠানকে যতই সমদর্শী, সাম্যময় করে তোলার চেষ্টা হোক, যতই আধুনিক হোক বিয়েবাড়ির সাজসজ্জা, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির খাপের মধ্যে লিঙ্গসাম্যকে আঁটানোর চেষ্টা চৌকো গর্তে গোল খুঁটি আঁটানোর মতোই দুঃসাধ্য। মেয়েদের স্বগৃহ ছেড়ে প্রস্থান, অতঃপর শ্বশুরগৃহে বেতনহীন গৃহকর্ম ও শুশ্রূষার প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ— বিবাহিত জীবনে প্রধান রীতিগুলি মেয়েদের স্বাধিকার বা স্বাতন্ত্র্যের অনুকূল নয়। বরং মেয়েদের স্বেচ্ছা-আনুগত্যই প্রথাগত দাম্পত্যের শর্ত। বিয়েবাড়ি, বিয়ের অনুষ্ঠান যতই সৌন্দর্যপূর্ণ হোক না কেন, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরের ক্ষমতা-অসাম্য এখনও অসুন্দর, যেমন ছিল পূর্বমাতৃকাদের সময়ে। জাত-ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে মেয়েদের ইচ্ছামতো জীবনসঙ্গী নির্বাচন কিংবা বিবাহ-নিরপেক্ষ ভাবে উত্তরাধিকার লাভের প্রথা যদি কখনও প্রচলিত হয়? তখন হয়তো বিয়েবাড়ি চেনা যাবে, চেনা যাবে না বিয়েকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy