কলকাতা হাই কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে এই একুশ শতকে যত কথাই হোক, সমাজ এমনকি শাসনব্যবস্থারও যে অনেক পথ হাঁটা বাকি, আরও এক বার তা বোঝা গেল কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের সাম্প্রতিক রায়ে। সরকারি কাজে তাঁর পৈতৃক জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তাই ক্ষতিপূরণ হিসাবে সরকারি নির্দেশিকা মেনেই চাকরির আবেদন জানিয়েছিলেন এক মহিলা, রাজ্য সরকার তা খারিজ করেছিল এই যুক্তি দেখিয়ে যে তিনি বিবাহিতা, তাই বিশেষ কোটায় চাকরি পাওয়ার উপযুক্ত নন। তারই জেরে মামলায় ২০১৪ সালে হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, বিবাহিতা মেয়েকেও পিতৃকুলের পারিবারিক সদস্য হিসাবে গণ্য করতে হবে। রাজ্য সরকার এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যায়, ডিভিশন বেঞ্চও সম্প্রতি সরকার পক্ষের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে।
বিয়ের আগে বা বিয়ের পরে, বৈধব্য বা সন্তানহীনতার মতো পরিস্থিতি-সহ নানা ক্ষেত্রে নারীর জমি বা সম্পত্তির অধিকার কিংবা ক্ষতিপূরণ নিয়ে এ রাজ্যের নানা প্রান্তে যে ঘটনাগুলি নিরন্তর ঘটে চলেছে, প্রচারমাধ্যম সূত্রে তা অনেকের জানা। যে ঘটনাগুলি আদালত অবধি গড়ায় সেগুলিই জানা যায়; যে নারীরা মামলা করেন ও লড়েন তাঁদের যে কী পরিমাণ পারিবারিক ও সামাজিক অস্বস্তি হেনস্থা এমনকি নিগ্রহ পেরিয়ে আসতে হয় তা কহতব্য নয়, গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে সমাজকাঠামো এখনও যারপরনাই তৎপর। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়াটা সমাজের বঞ্চনার অস্ত্র, বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ির পরিচয় সেঁটে দিয়ে পিতৃকুলের উত্তরাধিকার ও প্রাপ্য অধিকার আত্মসাৎ করার কৌশল। মেয়েদের এই অধিকার আদালতের হস্তক্ষেপেই রক্ষিত হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্ট নানা সময়ে তাদের রায়ে স্পষ্ট করে দিয়েছে বিবাহিতা, বিবাহবিচ্ছিন্না বা বিধবা মেয়েদের পিতৃকুলের সদস্য বলে গণ্য করার কথা, পৈতৃক জমি বাড়ি বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে অধিকারের কথা, পুরুষ উত্তরাধিকারীর পাশাপাশি নারীরও অধিকার-সাম্যের কথা। সমাজ, পরিবার তা না মানলে তা এই প্রতিষ্ঠানগুলিরই ব্যর্থতা, ভরসা বিচারব্যবস্থাই।
সমাজমনের অনগ্রসরতা দুর্ভাগ্যের। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ হিসাবে একটি চাকরি দিতে রাষ্ট্র তথা সরকারও অস্বীকৃত হচ্ছে, হাই কোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছে এবং সরকার পক্ষের দীর্ঘসূত্রতায় সেই মামলা বকেয়া থেকে যাচ্ছে দীর্ঘ দশ বছর প্রায়, এই সার্বিক আচরণ কি বিস্ময় ও আশঙ্কা জাগায় না? মামলাকারী মহিলা বিবাহিতা, এই কারণ দেখিয়ে তাঁকে চাকরি বা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ না দেওয়াটা বৈষম্যের শামিল— নাগরিক অধিকারের পরিসরে যে বৈষম্য দূর করার কথা সরকার বড় মুখ করে সর্বদা বলে থাকে, এবং যে কাজ করতে সে প্রতিশ্রুত, দায়বদ্ধ। বিবাহিত পুরুষের ক্ষেত্রে যেখানে পিতার সম্পত্তির আইনি উত্তরাধিকারী হতে বাধা নেই, সেখানে বিবাহিতা নারীর কেন সেই বাধা থাকবে, এই সহজ কথাটি নিরন্তর উচ্চারণ ও আচরণ করলে সরকারকে আর আদালত অবধি যেতে হত না। পুরুষতন্ত্রের চালিয়ে যেতে চাওয়া বৈষম্যের স্থিতাবস্থা ভাঙবার দায়িত্ব যার, তারই কথায় ও কাজে অসাম্য ফুটে বেরোলে তা দুর্ভাগ্যজনক। আদালত আছে বলে রক্ষা, কিন্তু এ-ই কি সমাধান?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy