Advertisement
০১ মে ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

অনর্থক

জেলা প্রশাসনের ক্ষমতা বাড়ানোর পিছনে ছিল দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থার আশ্বাস, প্রকল্পের দ্রুত রূপায়ণের যুক্তি। কাজের বেলা তা হল কি?

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৫
Share: Save:

সত্য কথাটি হল, আট জুলাই বাংলার মানুষ শান্তিতে ভোট দিয়ে ঘরে ফিরবেন, এমন আশা পোষণ করার জন্যও অনেকখানি কল্পনাশক্তি লাগে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে বসছে এ বারের মনোনয়ন-পর্ব থেকে সূচিত হিংসার স্রোত। বাস্তবিক, এই ভোট-হিংসার চরিত্রটি অদ্ভুত। আর্থিক বঞ্চনা, সামাজিক অন্যায়ের নিরসনের জন্যই যেন কখনও-কখনও রাজনীতিতে সংঘাত অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষদের আন্দোলনের প্রতি অতীতে অনেক বার নিষ্ঠুর হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। নানা সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে দেখা গিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলি সব শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্বের দাবি করলেও, বাস্তবে কিছু প্রধান স্বার্থগোষ্ঠীর মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। বললে ভুল হবে না, রাজনৈতিক সংঘাত কার্যত হয়ে উঠেছে ক্ষমতার লড়াই, এবং ক্ষমতায়নের লড়াই— কার ভাগে কতখানি ক্ষমতা পড়বে, হিংসা দিয়েই তার মীমাংসা। এবং তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের অসহায় আত্মরক্ষার পথও সেই হিংসা। পীড়ন থেকে মুক্তির আশায় বহু মানুষ প্রাণহানি, কারাবাস, ঘরছাড়া হওয়ার আশঙ্কা মাথায় নিয়েও রুখে দাঁড়াতে চান, যদি পাশে থাকে কোনও রাজনৈতিক বলশালী। আজ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে দেখতে হয়, গ্রামের উন্নয়ন, গ্রামবাসীর জীবিকার সুরক্ষা, কিংবা দরিদ্রের রাজনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্নে দলগুলির অবস্থানে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। আগের জমানার মতোই তৃণমূলের শাসনকালেও পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দশা গজভুক্ত কপিত্থবৎ— ফলের খোলাটাই কেবল রয়েছে, ভিতরটা ফাঁপা। গ্রামসভাগুলি কার্যত অচল। সাম্প্রতিক ‘দুয়ারে সরকার,’ ‘দিদিকে বলো’ প্রভৃতি কার্যসূচিতে জমা-পড়া আবেদন ও অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রামীণ চাহিদার আন্দাজ করছে রাজ্য সরকার।

জেলা প্রশাসনের ক্ষমতা বাড়ানোর পিছনে ছিল দক্ষ ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক ব্যবস্থার আশ্বাস, প্রকল্পের দ্রুত রূপায়ণের যুক্তি। কাজের বেলা তা হল কি? একশো দিনের প্রকল্প, আবাস যোজনায় দুর্নীতি এমনই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে হিসাব বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। পানীয় জলের প্রকল্পের রূপায়ণে খামতির জন্য ক্ষোভ ছড়াচ্ছে। ‘পথশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণা করেও বেহাল রাস্তার অভিযোগ উঠছে। সর্বোপরি, গ্রামের মানুষের কণ্ঠ নিরুদ্ধ হয়েছে। পঞ্চায়েতে দুর্নীতি, ঠিকাদারতন্ত্রের অভিযোগকে বার বার ‘বিরোধীদের অপপ্রচার’ বলে উপেক্ষা করেছে শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, পঞ্চায়েতের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সরাসরি তাঁকে জানাতে। প্রশ্ন হল, কেন তাঁকেই জানাতে হবে? মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্ত্রী, পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের ‘হেড দিদিমণি’ নন। বরং পঞ্চায়েত সদস্যদের দুর্নীতি রুখতে তাঁর দল ব্যর্থ কেন, মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রশ্নের উত্তর দিন। অপর পক্ষে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাসীর প্রতি কিছুমাত্র দায়বোধ থাকলে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি— যেটি আজ রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল— একশো দিনের কাজের প্রকল্প কিংবা আবাস যোজনা স্থগিত করতে পারত না। টাকার হিসাব মেলাতে গিয়ে নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করা চলে না।

সময়ের সঙ্গে পঞ্চায়েতের ভূমিকা বদলাতে পারে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পঞ্চায়েতের কর্তব্য সম্পর্কে নতুন নতুন চিন্তাভাবনা করতে পারে। কিন্তু পঞ্চায়েত যে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পরিসর, সংবিধানের এই কথাটিকে মানা দরকার। তা না হলে গ্রামের উন্নয়নে গ্রাম পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকাই থাকে না, পঞ্চায়েতে গ্রামবাসীর প্রতিনিধি নির্বাচনও অর্থহীন বিধিপালনে পর্যবসিত হয়। প্রচারপর্বে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে নেতারা কেউ বলছেন লোকসভা ভোটের সেমিফাইনাল, কেউ বিধানসভা ভোটের কোয়ার্টার ফাইনাল। যেন মানুষের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার প্রশ্ন গৌণ, তাঁদের ভোট ‘আরও বড়’ কোনও খেলার দান মাত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Panchayat Election 2023 village
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE