মণিপুরের প্রতিবাদ সভা। —ফাইল চিত্র।
দেশভাগের যন্ত্রণায় দীর্ণ স্বাধীনতার ক্ষয়ক্ষতি শুরু হয়েছিল প্রথম পর্ব থেকেই, কিন্তু— কিছু সাময়িক ব্যতিক্রম বাদ দিলে— তার শিকড়টি দীর্ঘকাল অবধি অক্ষত ছিল। ছিল বলেই বহু আঘাত সহ্য করে এবং প্রতিহত করে স্বাধীন ভারত তার গণতন্ত্রের সাধনা থেকে ভ্রষ্ট হয়নি। কিন্তু বর্তমান শাসককুল গত ন’বছরে দেশটাকে অবিশ্বাস্য মাত্রায় বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিরা স্বাধীনতা বলতে যা বুঝিয়েছিলেন, আজকের ভারত তা থেকে অনেক দূরে। সংবিধান এখনও আছে, এখনও তাকে যমুনার কালো জলে ভাসিয়ে তার জায়গায় কোনও একটি সংহিতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। ব্যক্তিনাগরিকের স্বাধীনতাই সেই সংবিধানের ভিত্তি, এই প্রাথমিক কথাটুকু এখনও সরাসরি অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু কার্যত? মণিপুর অথবা হরিয়ানা, যে দিকেই তাকানো যাক না কেন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণের প্রক্রিয়াটি ‘উদিত সূর্য’-এর মতোই স্পষ্ট। যাঁরা শাসকদের বিরাগভাজন, তাঁদের বিরুদ্ধে হিংস্র বিদ্বেষ ভয়াল রূপ ধারণ করলেও রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় এবং নীরব থেকে বুঝিয়ে দেয়, দেশের সংবিধানের কাছে, প্রশাসনিক কাঠামোর কাছে বিচার প্রার্থনা করার সুযোগ প্রকৃতপক্ষে তাঁদের নেই। রাষ্ট্রক্ষমতার অধীশ্বররা তাঁদের ‘অপর’ বলে চিহ্নিত করেছেন, সমনাগরিক হওয়ার সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারটি থেকে তাঁরা বঞ্চিত। শুধু এই দু’টি রাজ্যের কথা নয়, দেশের সংখ্যালঘু মানুষের মাথার উপরে নয়া নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জির খড়্গ ঝুলিয়ে রেখে কি প্রতিনিয়ত তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয় না যে, রাষ্ট্রের চোখে তাঁদের সমনাগরিকত্বের মৌলিক দাবিটি স্বীকৃতি পায় না? এ কেমন ‘স্বাধীনতা’?
যেখানে প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক হিংসা অথবা ডিটেনশন ক্যাম্পের জুজু নেই, সেই পরিসরগুলিও কি স্বাধীন? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আক্রান্ত হয়েছে মসজিদ-চার্চ, গোরক্ষকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন সংখ্যালঘু মানুষ, এখন প্রকাশ্যে সংখ্যালঘুর ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া হচ্ছে; উচ্চবর্ণের পাত্র থেকে জল পান করার ‘অপরাধ’-এ খুন হয়েছে দলিত বালক, গণধর্ষিতা হয়েছেন নারী। সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে জেলে বন্দি বহু মানুষ; তথ্যের নিরাপত্তা আইনের মোড়কে নাগরিকের উপর নজরদারির ব্যবস্থা আরও পাকা হচ্ছে। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘতর করা অনাবশ্যক। এই সন্দেহ অস্বাভাবিক নয় যে, বর্তমান ভারতে স্বাধীনতা বহাল আছে মুখ্যত হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের নাগরিকদের জন্য, অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হিন্দিভাষী উচ্চবর্ণের পুরুষদের জন্য, অবশ্যই শাসকদের প্রতি আনুগত্য সাপেক্ষে। ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-বাসস্থান-লিঙ্গ-যৌনতা— অক্ষগুলির যে কোনওটিতে যাঁরা ‘অপর’, তাঁদের জন্য অধিকারলঙ্ঘনই বরাদ্দ। এবং, তার চালিকাশক্তি হল বিদ্বেষ ও ঘৃণা, যা ক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে। প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত, পরাজিত হচ্ছে নাগরিক স্বাধীনতার অলঙ্ঘ্য অধিকার।
তবে কি এই পরাজয়ই সত্য? ক্রমে গাঢ়তর অন্ধকার সেই আশাহীনতার দিকেই ঠেলে দিতে চায় বটে, কিন্তু তা-ই শেষ সত্য নয়। এ কথাও তো মিথ্যা নয় যে, বিরোধী রাজনীতির পরিসর থেকেই স্লোগান উঠেছে, ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে হবে। কোন নেতার কোন কর্মসূচিতে এই স্লোগানের জন্ম, তা গৌণ প্রসঙ্গ। আশার কথা এইটুকুই যে, ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোতেই এখনও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সহমর্মিতার কথা বলা যায়— ঘৃণা দিয়ে ঘৃণার শোধ তোলা নয়, ভালবাসা দিয়ে শুশ্রূষা করার কল্পনা এখনও সম্ভব। আজকের মতো অন্ধকার সময় স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কখনও আসেনি, এমনকি ১৯৭৫ সালেও নয়; কিন্তু সেই অন্ধকারের নির্মোক ভেদ করে ভারত নামক ধারণাটির প্রদীপ ক্রমে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে, রাজনীতির পরিসরেই এই আশার কারণ রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy