ভারতীয় রাজনীতিতে ঘৃণার মূল উৎস যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, তা নিয়ে সংশয় নেই। প্রতীকী ছবি।
ভারতবাসী এত দিনে ঘৃণাভাষণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বুঝে নিয়েছে, এটাই এখন রাজনীতির ভাষা। বিশেষত, সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতির। কিন্তু, এই অভ্যাসটি যে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, সে কথাটি আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দিল দেশের শীর্ষ আদালত। বিচারপতি কে এম জোসেফ ও বি ভি নাগারত্নর বেঞ্চ ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’দের ঘৃণাভাষণ ঠেকাতে না-পারার জন্য সরকারকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করল। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, প্রবণতাটি শুধু তথাকথিত ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রিবর্গ, বিভিন্ন রাজ্যের উচ্চপদস্থ মন্ত্রিবর্গ, শাসক দলের গুরুত্বপূর্ণ বহু নেতা যেমন অবলীলায় ঘৃণা উগরে দেন প্রকাশ্য ভাষণে, বিরোধী আসনে থাকা বড় মাপের নেতারাও সেই একই কাজ করে থাকেন। ঘৃণার বয়ানই এখন ভারতীয় রাজনীতির মূলস্রোত। সেই স্রোতে বাঁধ দেওয়ার কর্তব্যটি ছিল সরকারের। বর্তমান শাসকরা সে কাজে ব্যর্থ, এমন কথা বললে অনৃতভাষণ হবে— কর্তব্যটি তারা স্বীকারই করেনি। বরং কেউ অভিযোগ করতে পারেন যে, ঘৃণাভাষণে পারদর্শিতাই এখন রাজনৈতিক উত্থানের সহজতম পথ। মহাজনের পথ অনুসরণীয়, রাজনীতির ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’রা সে কথা বিলক্ষণ জানেন। প্রশ্ন হল, আদালতের তিরস্কার কি শাসকবর্গের চৈতন্যোদয়ে সক্ষম হবে? না কি, তাদের রাজনীতির সঙ্গে এই ঘৃণার বয়ানের সম্পর্ক এমনই অঙ্গাঙ্গি যে, সেই বয়ান বর্জন করতে গেলে দলের রাজনীতিরই আগাগোড়া বিসর্জন দিতে হয়? উত্তরটি ভারতীয় গণতন্ত্র আঁচ করতে পারে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, যত ক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে থাকবে, তত ক্ষণ অবধি এই ঘৃণাভাষণের প্রবণতা থামবে না। ভারতীয় রাজনীতিতে ঘৃণার মূল উৎস যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, তা নিয়ে সংশয় নেই। বিচারপতিরা গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের একটি অতিব্যবহৃত বাক্যাংশ উল্লেখ করেছেন: ‘পাকিস্তানে চলে যান’। এর সূত্রও ধর্মীয় বিদ্বেষেই নিহিত। কিন্তু, আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন যে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ কি ঘৃণাভাষণের জরুরি বা যথেষ্ট শর্ত— অর্থাৎ, ঘৃণাভাষণের জন্য কি রাজনীতিতে ধর্মের মিশেল থাকতেই হবে; এবং, রাজনীতিতে ধর্ম থাকলে কি ঘৃণাভাষণ থাকবেই? দু’টি প্রশ্নের উত্তরই, দ্ব্যর্থহীন ভাবে, না। ভারতীয় রাজনীতির চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা আছে, এমন পর্যবেক্ষকমাত্রেই স্বীকার করবেন, রাজনীতির মূলধারায় প্রধানতম প্রবাহ হোক বা না হোক, স্বাধীনতার আগে বা পরে ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম সর্বদাই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। আদালত তার পর্যবেক্ষণে জওহরলাল নেহরুর কথা উল্লেখ করেছে। সেই নেহরু যুগেও ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম ছিল, এমনকি শাসকপক্ষেই ছিল। কিন্তু, তা থেকে এমন সর্বগ্রাসী ঘৃণাভাষণের জন্ম হয়নি। কেন, সেই উত্তরটিও স্পষ্ট— যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন, তাঁরা চাননি বলে। অন্য দিকে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রাজনীতিতে এখন ঘৃণাভাষণের বন্যা বইছে— ট্রাম্পের আমেরিকা যার মোক্ষম উদাহরণ। তেমন দেশগুলির বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই ধর্ম রাজনীতির প্রধান, বা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ, চালিকাশক্তি নয়। অর্থাৎ, আদালত তার পর্যবেক্ষণে ঘৃণাভাষণের সঙ্গে রাজনীতিতে ধর্মের সংযোগের উপর যতখানি জোর দিয়েছে, প্রকৃতপ্রস্তাবে সেই সম্পর্ক সম্ভবত তত ঘনিষ্ঠ নয়। বরং আশঙ্কা হয়, আদালতের এই পর্যবেক্ষণটি কেউ ভিন্নার্থে ব্যবহার করতে পারেন। বলতে পারেন যে, ভারতীয় রাজনীতি থেকে যে-হেতু ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা কার্যত অসম্ভব, ফলে ঘৃণাভাষণের রাশ টানাও সরকারের সাধ্যাতীত। এই ব্যাখ্যাটি নিঃসন্দেহে ভারতের শাসকপক্ষকে স্বস্তি দেবে। আদালত যে এ-হেন স্বস্তির কথা বলছে না, বরং সরকারকে তার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সে কথাটি আরও এক বার স্পষ্ট ভাবে বলা জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy