Advertisement
২২ মে ২০২৪
Indian Government

আত্মমুগ্ধ

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা কার্য-কারণ সম্বন্ধ— বিবিসি-কাণ্ডকে যে সূত্রেই ফেলা যাক না কেন, ঘটনার চেয়েও আশ্চর্য হতে হয় তার সময়টি দেখে।

picture of BBC.

বিবিসি-র দিল্লি ও মুম্বই অফিসে আয়কর ‘অনুসন্ধান’ হল। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ ০৬:৪৭
Share: Save:

যারে দেখতে নারি তার চলন-বলন সবই বাঁকা। কেবল স্খলনটি সোজাসাপটা। জানুয়ারিতে বিবিসি-র তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন নিয়ে হুলস্থুল পড়েছিল, ফেব্রুয়ারিতে জানা গেল, ভারতে বিবিসি-র ব্যবসাপত্রে গন্ডগোল আছে, কিছু ক্ষেত্রে আয়করই দেয়নি! অর্থাৎ, বিদেশি সংস্থা দেশের আইন ভেঙে কাজ করে যাচ্ছে, সাংঘাতিক ব্যাপার। সুতরাং বিবিসি-র দিল্লি ও মুম্বই অফিসে আয়কর ‘অনুসন্ধান’ হল। মার্চের প্রথম দিনটিতে রাজধানীতে ভারতের বিদেশমন্ত্রী ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রীকে ‘দৃঢ় ভাবে’ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের মাটিতে কাজ করতে হলে এ দেশের আইন, নিয়মকানুন মেনে কাজ করতে হবে সবাইকে— বিবিসি-কেও। কূটনীতিতে সৌজন্য ও শিষ্টতা বড় বালাই, নয়তো ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী প্রতিপ্রশ্ন করতে পারতেন— এ যদি বিবিসি-র তরফে আইনভঙ্গই হয়ে থাকে, তা হলে ভারতের বিরোধী দলগুলি, এবং এডিটরস গিল্ড বা প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া-র মতো সর্বভারতীয় সংবাদ সংগঠনগুলি কেন ভিন্ন কথা বলছে, কেন এদের চোখে এই আয়কর অনুসন্ধান আসলে নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রত্যাঘাত।

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা কার্য-কারণ সম্বন্ধ— বিবিসি-কাণ্ডকে যে সূত্রেই ফেলা যাক না কেন, ঘটনার চেয়েও আশ্চর্য হতে হয় তার সময়টি দেখে। ভারতের মাটিতে বিবিসি-র কাজকর্ম আজকের নয়, অথচ তাদের আইন মানা না-মানা নিয়ে এত কাল খোঁজ পড়েনি, পড়ল ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা প্রসঙ্গে তাদের তৈরি তথ্যচিত্র সম্প্রচারের পরে। বর্তমান সরকার যে কোনও রকম সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, ভারতে এ এখন অতি পুরনো কথা, বিরুদ্ধ স্বরকে চুপ করাতে সরকারের দ্বিমুখী অস্ত্রটিও বহুচর্চিত। যে কোনও নিন্দা-সমালোচনাকে ভারতবিরোধিতার মোড়কে পুরে প্রচার, পরে আর্থিক বা আনুষঙ্গিক অভিযোগ এনে হেনস্থা। এই অস্ত্র নেমে আসছে একের পর এক ব্যক্তি ও সংস্থার ক্ষেত্রে। সাংবাদিক, সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে। বিদেশিদের ক্ষেত্রেও। বিবিসি-র অফিসে কর্মীদের প্রায় আটকে রেখে চলছে আয়কর হানা; এমনকি ব্রিটেনের মাটিতে বলা রাহুল গান্ধীর বক্তব্যকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে এমন ভাবে পেশ করছেন বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যাতে মনে হয় বিরোধী নেতা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। অর্থাৎ মূল কথাটি হল, যে কোনও ভাবে, যে কোনও মূল্যে সরকারের সমালোচনাকে এনে ফেলতে হবে ভারতবিরোধিতার ছকে— হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর রিপোর্টে আদানিদের কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগকেও বলা হবে ভারতের উপর ‘পরিকল্পিত হামলা’, আমেরিকান লগ্নিকারী জর্জ সোরস আদানি-কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুললে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলবেন সোরস ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতি চান, নিশ্চয়ই তাঁর অন্য স্বার্থ আছে।

তবে হাতে রইল কী? এক দিকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ঢাক পেটানোর কাঠি, অন্য দিকে গণতান্ত্রিক সমালোচনাকে নিরন্তর চোখ রাঙিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় কদাচরণ। আত্মমুগ্ধ সরকার এ কথাটি বুঝছে না যে এই সমস্ত ঘটনা, সরকারের প্রতিটি প্রতিস্পর্ধী পদক্ষেপ ওই সমালোচনার সারবস্তুকেই নতুন করে প্রমাণ করছে, দেশের গণতন্ত্রকে বিশ্বের চোখে ছোট করছে। সংবাদের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নেমে আসা আঘাত নিয়ে বিশ্বের যখন কিছু জানতে বাকি নেই, দেশবিরোধিতার কুমিরছানা দিয়ে গোটা বিশ্বকে বেশি দিন ভোলানো যাবে কি? বিদেশি সংবাদমাধ্যমের অফিসে আয়কর হানা দিয়ে বিরুদ্ধ বা অপ্রিয় সমালোচনা রোখা যাবে কি? জি২০ নেতৃত্ব, বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, এই সবের পাশে ভারতের এ-হেন অন্ধ আত্মগর্ব মানায় কি না, দিল্লিকেই ভাবতে হবে। বিশ্ববিরক্তি উদ্রেক না করে খোলামনে অন্যের কথা শুনলে কেমন হয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Government BBC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE