Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Mamata Banerjee

খোদকারি

মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতটি তো তিনি পাল্টাতে বলছেন না, তাঁর প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী নতুন শব্দ-সম্বলিত গানটি ব্যবহৃত হবে ‘রাজ্যের গান’ হিসাবে।

Mamata Banerjee.

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৩৩
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটির কথা পাল্টে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। কথাটি তাঁর মুখ থেকে পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই পারিষদবর্গের কেউ কেউ এই প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন। অনুরাগীরা বোধ করি নেত্রীর বিবেচনাবোধে যারপরনাই পুলকিত— গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা বলেই না তিনি অন্যদের মতামত চেয়েছেন! সত্য বটে। যে ইচ্ছাময়ী সর্বাধিনায়িকা যখন তখন যে কোনও বস্তুপিণ্ডের যে কোনও নাম রাখেন, মুহূর্তের মধ্যে সরণিকে ধরণী বানিয়ে দেন, তিনি যে কলমের এক আঁচড়ে রবীন্দ্রনাথের লাইন পাল্টে দেওয়ার হুকুমনামা জারি করেননি, এতেই নিশ্চয়ই বাঙালির কবি আপনাকে ধন্য মানবেন। তবে কিনা, বঙ্গসমাজের কাণ্ডজ্ঞান হয়তো এখনও পুরোপুরি লোপ পায়নি, বাঙালির ঘটে তার ছিটেফোঁটা পড়ে আছে। সুতরাং আশা এইটুকুই যে, সচেতন এবং সুচেতন নাগরিকরা এই মুহূর্তেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেবেন যে মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রস্তাব’টি কখনওই সমর্থন করা যায় না। এমন প্রস্তাব দেওয়া বা চিন্তা করাই অনুচিত, অনৈতিক এবং বিপজ্জনক। সরকারি ক্ষমতা হাতে থাকলেই তার যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকার পাওয়া যায়— এই ধারণা দেশে এবং রাজ্যে উত্তরোত্তর কায়েম হয়ে চলেছে, তার বিষময় পরিণামও এখন অহরহ দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের দোহাই, এই খেয়ালখুশির তাণ্ডব আর নহে, আর নয়।

মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দিয়েছেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতটি তো তিনি পাল্টাতে বলছেন না, তাঁর প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী নতুন শব্দ-সম্বলিত গানটি ব্যবহৃত হবে ‘রাজ্যের গান’ হিসাবে। বিচিত্র ‘যুক্তি’। রাজ্য সরকার রাজ্যের গান নির্বাচন করতে চায়, ভাল কথা। কোন গান নির্বাচিত হবে তা নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে। সে জন্য যদি নতুন কোনও গান লেখার সিদ্ধান্ত হয়, তারও পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলতে পারে, সেই গান কে বাঁধবেন এবং কে বা কারা গাইবেন, সে-সবও হতে পারে আলোচনার বিষয়, যদি অবশ্য তেমন আলোচনার আদৌ কোনও অবকাশ থাকে। কিন্তু কোনও পুরনো গান সে জন্য মনোনীত হলে সেটিকে অবিকৃত কথায় এবং সুরে ও যথাযথ শৈলীতে পরিবেশন করতে হবে, এই নীতি অলঙ্ঘনীয়। বিশেষত, রবীন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক এবং অনন্য একটি গানের কথার একটি অক্ষর পাল্টানোও তাঁর প্রতি ভয়ানক অমর্যাদার পরিচায়ক, সুতরাং বাংলা ও বাঙালির আত্মমর্যাদার পক্ষেও চরম হানিকর। ‘সংশোধিত’ রাজ্যসঙ্গীত আপন অঙ্গে সেই অমর্যাদার কলঙ্ক বহন করবে— মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা চান না।

কেন এই পরিবর্তনের ভাবনা? নেত্রীর বক্তব্য: ‘বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন’ বললে বাংলার সব মানুষকে বোঝায় না, তাই ‘বাংলার প্রাণ বাংলার মন’ গাওয়া শ্রেয়। ভুল এবং নিতান্তই অগভীর তাঁর এই ধারণা। বাংলা যে অর্থে এই রাজ্যের সর্বজনীন ঠিকানা, বাঙালিও সেই একই অর্থে রাজ্যবাসীর সার্বজনিক পরিচিতি। ভাষা সেই পরিচিতির গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা, কিন্তু একক মাত্রা নয়। রবীন্দ্রনাথ যে বৃহৎ বাংলা ও বাঙালির সত্তাকে আপন চিন্তায়, সৃষ্টিতে ও কাজে সার্থক করে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে দু’টি শব্দই একে অন্যের দিগন্তপ্রসারী ব্যঞ্জনায় মহিমময়। বস্তুত, বাংলার মাটি বাংলার জল গানটি সেই প্রসারিত বঙ্গচেতনার এক অসামান্য সৃষ্টিরূপ। ইতিহাসের এক কঠিন লগ্নে সম্প্রীতি ও সম্মিলনের আহ্বান হিসাবে এই গানের সৃষ্টি, তার পূর্ণ এবং পুণ্য পরিসরে সবাই সমান ভাবে সমাদরণীয়। বাঙালির প্রাণ এবং বাঙালির মন সেই অবাধ অনাবিল সর্বজনীন পরিসরটিকেই ধারণ করে। ‘বাঙালি’ শব্দটি নিয়ে কষ্টকল্পিত সমস্যার অবিবেচনাপ্রসূত সমাধানের খোদকারি না করে মুখ্যমন্ত্রী দু’দণ্ড স্থির হয়ে ভেবে দেখতে পারেন— এই গানের অবয়বে প্রথম দুই স্তবকের বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথ কেন পরের দু’টিতে বাঙালিতে পৌঁছলেন। সেটাই হবে প্রকৃত বিবেচনাবোধের পরিচয়। আত্মশুদ্ধির অনুশীলনও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Rabindranath Tagore West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE