Advertisement
১৭ মে ২০২৪
Press

কাশ্মীর মডেল?

দিল্লিতে সাংবাদিকদের সরকারি নথিভুক্তির উপর শর্ত আরোপে আবারও সেই সংবাদ-নিয়ন্ত্রণেরই প্রতিচ্ছবি।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:০৪
Share: Save:

ভারত নামেই প্রজাতন্ত্র, কাজে মোড়লতন্ত্র। নানা মন্ত্রকে বিবিধ কমিটি ও কমিশন নিষেধের চোখ রাঙাইয়া আর নির্বাসনের হুমকি দিয়া সকলকে জ্বালাতন করিবার বন্দোবস্ত এই দেশে। মোদী-শাসনকালে সাংবাদিকদের উপর মোড়লগিরি অনেকগুণ বাড়িয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রকের দফতরে প্রবেশের অনুমোদন পাইতে সাংবাদিকদের যে নথিভুক্তি (অ্যাক্রেডিটেশন) পাইবার প্রয়োজন হয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক সম্প্রতি তাহার নূতন নির্দেশনামা ঘোষণা করিল। কোনও সংবাদের জন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্য, জাতীয় নিরাপত্তা অথবা অপরাপর দেশের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ব্যাহত হইলে সাংবাদিকের নথিভুক্তি বাতিল হইতে পারে। শর্তগুলি পরিচিত, বাক্‌স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করিতে সংবিধানে সেইগুলির উল্লেখ রহিয়াছে। আধিকারিকরা জানাইয়াছেন, ওই শর্তগুলি নিহিত ছিল, তাহাদের প্রকাশ করা হইয়াছে মাত্র। প্রশ্ন উঠিবে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর পার করিয়া তাহার প্রয়োজন হইল কেন? কোনও সংবাদ জনস্বার্থ-বিরোধী মনে করিলে সরকারকে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে অথবা আদালতে তাহা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে, তবেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে। সাংবাদিকের নথিভুক্তির প্রাক্শর্ত হিসাবে জাতীয় নিরাপত্তা অথবা সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জুজু দেখাইবার প্রচেষ্টা কেন? সাংবাদিকের কাজে জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে পারে, ইহা এক সম্ভাবনা বটে। কিন্তু সাংবাদিককে নিগ্রহ, হয়রানি, হিংসার দ্বারা বিপন্ন করিয়া সংবাদের স্বাধীনতা ব্যাহত করিলেও দেশ বিপন্ন হয়। রাফাল বিমান ক্রয়ে দুর্নীতি, জাত অথবা ধর্ম-ভিত্তিক দাঙ্গার ছবি জনসমক্ষে আনিলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঐক্যহানির মামলা করিয়াছে সরকার। গত কয়েক বৎসরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত দ্রুত অনেকখানি নামিয়াছে। তাহাতে কি দেশের নিরাপত্তা এতটুকুও বাড়িয়াছে? এতটুকুও সবল হইয়াছে বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যের বোধ? না। সুতরাং, পুরোটাই ক্ষতির হিসাব।

দেশবাসী দেখিতেছেন, যখনই সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, নেতাদের স্বজনপোষণ, পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারা মানবাধিকার তথা নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখনই সাংবাদিকের উপর শাস্তির খাঁড়া নামিয়া আসে। এমনকি সংবাদমাধ্যমের সম্প্রসারণও বন্ধ হয়। সংবাদ-নিয়ন্ত্রণের এই প্রচেষ্টার চরম প্রকাশ অবশ্যই কাশ্মীরে। সেখানে ২০২০ সালে নির্মিত সরকারের মিডিয়া নীতির ঘোষিত উদ্দেশ্যই ছিল কাশ্মীরের সংবাদপত্র ও চ্যানেলগুলির সরকারি বিজ্ঞাপন পাইবার অনুমোদন বা সাংবাদিকের সরকারি নথিভুক্তির অনুমোদন ইত্যাদি সকল বিষয়ে শর্ত আরোপ। কাশ্মীরে যে সকল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ঘটিতেছে, তাহার তথ্য, ছবি, ভিডিয়ো প্রকাশে নিষেধাজ্ঞাও সেই শর্তের অন্তর্গত। শর্ত ভাঙিলেই তাহা ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’।

দিল্লিতে সাংবাদিকদের সরকারি নথিভুক্তির উপর শর্ত আরোপে আবারও সেই সংবাদ-নিয়ন্ত্রণেরই প্রতিচ্ছবি। কাশ্মীরের ছায়া ইতিমধ্যেই কেরলেও— যেখানে জাতীয় নিরাপত্তায় আঘাতের অভিযোগে একটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রসারণ বন্ধ হইয়াছে। কী কারণে এই কঠোর সিদ্ধান্ত, তাহার ব্যাখ্যা জনসমক্ষে আসে নাই, চ্যানেল কর্তৃপক্ষও তাহা জানিতে পারেন নাই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি বন্ধ খামে কারণ জানাইয়াছে কেরল হাই কোর্টকে, তাহার ভিত্তিতে বিচারপতি ওই চ্যানেলের লাইসেন্স খারিজের সিদ্ধান্ত সমর্থন করিয়াছেন। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও প্রশ্ন করিতে হয়, কারণ না দর্শাইয়া বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কি ভারতের সকল সংবাদমাধ্যমকেই বিপন্ন করে না? জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে হইলে সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ না করিয়া তাহার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই কি অধিক কার্যকর নহে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Press Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE