—প্রতীকী ছবি।
বোমা-গুলির দাপটে পিলে চমকিয়ে আসন্ন নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব শেষ হল, থেকে গেল শুধু সেই প্রশ্ন: “মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনি’ গল্পে শিক্ষাদানের ধুন্ধুমারে ছাত্রটি চোখের আড়ালে রয়ে গিয়েছিল। আর পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না খোদ পঞ্চায়েতকে। নেতারা মুখ খুললেই বেরিয়ে আসছে হুঙ্কার, তাচ্ছিল্য, ‘দেখে নেওয়া’-র আস্ফালন। এর সবটাই বিপক্ষের প্রতি। গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁদের বক্তব্য কী? কোনও দল এখনও পর্যন্ত ইস্তাহার প্রকাশ করেনি। হয়তো এই ভাল। দিনভর সংঘাতের দৃশ্য দেখে রাজ্যবাসীর অস্থির, আতঙ্কিত মন কী করেই বা বিচার করবে দারিদ্র দূরীকরণ, জীবিকার সুরক্ষা, সুস্থায়ী কৃষি, নারী সক্ষমতার যথাযথ উপায়? অথচ, গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের কেন্দ্রে রয়েছে এই বিষয়গুলিই। দলের প্রতি সমর্থন চাইতে গেলে যে রাজনৈতিক কার্যক্রমের উপযোগিতা ব্যাখ্যা করতে হয় ভোটদাতার কাছে, প্রমাণ দিতে হয় সুশাসনের, অবিরাম হিংসার স্রোতে সে সব ধারণা ভেসে যাচ্ছে। অথচ, নির্বাচনের প্রচারপর্ব হওয়ার কথা ছিল মূল্যায়নপর্ব। গ্রামের উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা, গ্রামবাসীর হালহকিকত নিয়ে আলোচনা হওয়ার এই তো সময়। প্রচারপর্বে এই প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হতে বাধ্য হন নেতারা। পরীক্ষকের ভূমিকা নেন সাধারণ মানুষ, তাঁদের প্রশ্ন জোগায় বিরোধী দল, ছোট-বড় নাগরিক সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম।
অতীতে দেখা গিয়েছে, জনপ্রতিনিধির প্রতি ভোটদাতার প্রধান অভিযোগ থাকে প্রতিশ্রুতি রূপায়ণে ব্যর্থতা নিয়ে। সেতু তৈরি হয়নি বলে বিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছেন যে গ্রামের বাসিন্দারা, যে গৃহহীন ঘর পাননি, যে কৃষকের ফসল ভেসে গিয়েছে নিকাশি নালা বুজে যাওয়ায়, তাঁদের কৈফিয়ত দিতে হয় রাষ্ট্রবলে বলীয়ান নেতাকে। এখানেই গণতন্ত্রের শক্তি। গ্রামের উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়ের নিরিখে এই প্রশ্নগুলির গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি উঠে আসে আরও কিছু প্রশ্ন, সেগুলি সরকার তথা ক্ষমতাসীন দলের নীতির কার্যকারিতা নিয়ে। সেই সব বিতর্ক থেকে গণতন্ত্রের নতুন পথের দিশা উঠে আসে। এ বার তেমন প্রশ্ন কি ছিল না? পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতব্যবস্থায় এক দশকেরও বেশি তৃণমূলের আধিপত্য চলছে। এই পর্বে দলীয় তথা সরকারি নীতি বিকেন্দ্রিত শাসনব্যবস্থার বিপরীতে হেঁটেছে, জেলা এবং ব্লক প্রশাসন উন্নয়নের প্রকল্পের পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত। গ্রাম সংসদ সভা, গ্রাম সভা রয়েছে কেবল খাতায় কলমে, বিভিন্ন প্রকল্পের উপভোক্তার তালিকায় অনুমোদনের ছাপ দিতে। গ্রামবাসীকে নিয়ে সহভাগী পরিকল্পনার কথা মুখেও কেউ আনে না।
ফলে, গ্রামের মানুষের কণ্ঠ শোনার পথগুলি রুদ্ধ হয়েছে। তাতে দুর্নীতির দরজাটি সহজে খুলে যায়, কিন্তু কালক্রমে গ্রামের মানুষের সঙ্গে সংযোগহীনতাই পরিণত হয় সমর্থনহীনতায়। তৃণমূল দেরিতে হলেও তা বুঝেছে, তাই ইদানীং গুটিকতক নেতার ফোন নম্বর দিয়ে নালিশ জানাতে বলা হচ্ছে। এ ভাবে বড় নেতারা ‘পরিত্রাতা’-র ভূমিকা নিয়ে খাটো করছেন পঞ্চায়েত সদস্যদের। উপরন্তু, তাতে মূল প্রশ্নটা চাপা পড়ছে না। তা হল, উন্নয়নের প্রকল্পে বিডিও-জেলাশাসকের প্রাধান্য দিয়ে পঞ্চায়েতকে এলেবেলে করে দেওয়ার নীতি কি কাজে দিয়েছে? গ্রামে আর্থিক উন্নয়ন বা সামাজিক ন্যায় আনতে পেরেছে? ক্রমবর্ধমান পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা, গৃহহীনের সংখ্যা, নাবালিকা বিবাহ বা শিশু অপুষ্টির হার তার বিপরীতেই সাক্ষ্য দেয়। অতএব কেবল দুর্নীতির বিচার করলেই চলবে না, প্রয়োজন ছিল প্রশাসনিক নীতির বিচার। আক্ষেপ, সে দিকে মন নেই কোনও দলের। হার-জিতের বাইরেও নির্বাচনের যে তাৎপর্য ছিল, তা হারাতে বসেছে রাজ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy