রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নেত্রীনেতাদের ধন্যবাদ, পুরনো বছরের মতিভ্রমকে তাঁরা নতুন বছর অবধি টেনে আনেননি। ২০২৩-এর শেষ বেলাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁদের খোদকারির কবল থেকে রেহাই পেলেন। তাঁর গানে বাঙালির প্রাণ বাঙালির মন বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন ফিরে এল, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবতীদের বিচিত্র ও উদ্ভট যুক্তিতে ‘বাঙালির’ কেটে দিয়ে ‘বাংলার’ বসিয়ে দেওয়ার বোধবুদ্ধিহীন অহঙ্কার প্রত্যাহৃত হল। সরকারি নির্দেশে রাজ্য সঙ্গীতের যে বয়ান প্রকাশিত হয়েছে, সেটি রবীন্দ্রনাথের অবিকৃত সৃষ্টি। সেই নির্দেশিকায় গানটির সমৃদ্ধ ইতিহাসের উল্লেখ থাকলে কর্তা-কর্ত্রীদের চিন্তা ও ধারণার গভীরতার পরিচয় মিলত, কিন্তু এই জমানায় তেমন কোনও জ্ঞানচর্চার আশা করাও বোধ করি বাতুলতা। সরকারি নির্দেশিকায় সংযোজিত রোমান হরফে লেখা বাংলা গানটিকে কেন তার ‘ইংরেজি রূপ’ বলা হল, সে-প্রশ্নও সম্ভবত একই কারণে দুরাশার পরিচায়ক— অধুনা এ রাজ্যের সরকারি মহলে হরফ এবং ভাষার পার্থক্য নিরূপণের সাধ অথবা সাধ্য নিতান্তই বিরল।
তবে কিনা, রাজ্য সঙ্গীত এবং তার সংশ্লিষ্ট আচার-আচরণের বিধি— গানের সময় টান-টান হয়ে দাঁড়ানো-সহ— পালনের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেটি একই সঙ্গে সমকালীন দিল্লীশ্বর এবং কালজয়ী হাল্লা-রাজার কথা মনে পড়িয়ে দিতে পারে। এত দিনে পশ্চিমবঙ্গ একটি রাজ্য সঙ্গীত পেল, ভাল কথা, কিন্তু তা নিয়ে এমন হুকুম জারির বহর দেখলে বলতেই হয়, গানটির রচয়িতা— যিনি তাসের দেশ-এর স্রষ্টাও বটে— খুশি হতেন না। সে কথা নাহয় তোলা থাকুক। চতুর্দিক থেকে, এমনকি অন্দরমহল থেকেও, প্রতিবাদ ও সমালোচনা শুনে সরকার বাহাদুর যে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে দেওয়ার দুর্মতি পরিত্যাগ করেছেন, তাকে সুলক্ষণ বলে মানতেই হবে। এবং, সুমতি সতত স্বস্তিকর। অকপট উচ্চকণ্ঠে ভুল স্বীকার করে নিতে পারলে তাঁদের মর্যাদা আরও বাড়ত, তবে সে জন্য মর্যাদা এবং অহঙ্কারের পার্থক্য জানা দরকার। বোঝা দরকার যে, প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে জনসাধারণের কাছে মার্জনা চেয়ে নেওয়ার সু-অভ্যাস একই সঙ্গে শাসকের সম্মান বাড়ায় এবং প্রশাসনকে উন্নততর করে তোলে।
বস্তুত, আত্মসংশোধন যথার্থ গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত। সেই শর্ত মানতে হলে শাসককে নিজের কৃতকর্মের নির্মোহ বিচার করতে হয়। ক্ষমতা হাতে আছে বলেই তার অপব্যবহার করে অন্যায় আধিপত্য জারি করতে হবে, এই ধারণা বিসর্জন দিতে হয়। সে বড় সহজ কথা নয়। সহজ কথা যে নয়, তা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকবর্গের পূর্বসূরিদের দিকে তাকালেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। বামফ্রন্ট তথা তার প্রধান শরিক দলের নায়করা যে নির্বোধ ভ্রান্তির কারণে তাঁদের সাধের রাজ্যপাট হারিয়েছিলেন, আজও— ক্ষমতাচ্যুতির এক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এবং রাজ্যের সংসদীয় রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া সত্ত্বেও— সেই ভুল তাঁরা স্বীকার করতে নারাজ। রাজ্য ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকালে ভুল স্বীকারের প্রশ্নটিকেই ভুলে যেতে হয়। শাসক ভুল করতে পারে, এমন ধারণা ভারতের বর্তমান শাসকরা মানেন না, তাঁদের শাসন-তন্ত্রে সেই ধারণার কোনও স্থানই নেই। এই দুর্মর এবং অটল অহমিকা কী ভাবে গণতন্ত্রের ভিতটিকে নষ্ট করে দিতে পারে, এক দশক ধরে ভারতের নাগরিকরা কার্যত প্রতিনিয়ত তার সাক্ষী। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাজ্য সঙ্গীতের বৃত্তান্তটি তার নিজস্ব প্রসঙ্গের বাইরে বৃহত্তর অর্থেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের শাসকরা তাঁদের এই অভিজ্ঞতাকে সদর্থক আত্মশুদ্ধির কাজে ব্যবহার করলে তাঁদের নিজেদেরও উপকার হবে। নমনীয় মানে দুর্বল নয়— এই সত্যটিকে আপন আচরণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে নাগরিকদের শ্রদ্ধা এবং আস্থা দুই-ই বাড়তে পারে। নতুন বছরের এক সপ্তাহও কাটেনি, এই আনকোরা সময়কে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করতে দোষ কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy