পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থার সঙ্কট গভীরতর হচ্ছে। প্রতীকী ছবি।
পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থার সঙ্কট গভীরতর হচ্ছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে, মূল্যস্ফীতির হার প্রবল। এক ডলারের মূল্য হয়েছে ২৭৫ পাকিস্তানি রুপির চেয়েও বেশি। গত বছর সে দেশে এক বিধ্বংসী বন্যা হয়েছিল— দেশের প্রতি তিন জন মানুষের মধ্যে এক জন তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। দেশের অর্থব্যবস্থায় স্বভাবতই তার প্রভাব পড়েছে। তবে, পাকিস্তানের মূল সঙ্কট এখন ঋণ। পরিস্থিতি এমনই যে, ঋণখেলাপির সম্ভাবনা প্রতি দিন প্রকটতর হচ্ছে। সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করলে বলতে হয়, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ঋণখেলাপি আরম্ভ করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার থেকে সৌদি আরব বা চিনের মতো বন্ধু দেশ, যেখানে সম্ভব, সেখানেই সাহায্যের জন্য হাত পাতছে পাকিস্তানের সরকার। সমস্যা হল, বিদেশি বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ এবং সাহায্যের ভরসাতেই পাকিস্তান দাঁড়িয়ে আছে— সেই খড়কুটোর সাহায্যে আজকের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। আজ যদি বৈদেশিক সাহায্য পাকিস্তানকে উদ্ধার করেও, তা বড় জোর বিপদকে কিছু দিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখতে পারবে মাত্র। অদূর ভবিষ্যতেই আবারও এই বিপদের মুখে দাঁড়াতে হবে দেশকে।
ঋণের সঙ্কট অথবা বন্যার ধাক্কায় অর্থব্যবস্থার কম্পমান অবস্থা, সবই এক গভীরতর বিপদের বিভিন্ন প্রকাশ। বিপদটি হল, পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থায় ‘দীর্ঘমেয়াদ’ বলে কোনও শব্দ নেই। সেখানে বর্তমানই সত্য— এই মুহূর্তে যতখানি গুছিয়ে নেওয়া যায়। ফলে, দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নেই, প্রকৃত বিদেশি লগ্নিও নেই। বিদেশি লগ্নির নামে যা আছে, এক অর্থে তা পাকিস্তানের পরিসরকে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের পারিতোষিক। অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হল ভোগ। সেই ভোগ অব্যাহত রাখতে কৃত্রিম ভাবে পাকিস্তানি রুপির দাম বাড়িয়ে রাখা, অথবা বিপুল ভর্তুুকি দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম কম রাখা পরিচিত পন্থা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা পাকিস্তানে আর্থিক ভাবে সম্পন্নদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক বা আর্থিক ভাবে সু-যোগাযোগের অধিকারীদের কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও সে দেশে ‘রেন্ট সিকিং’ বা ‘খাজনা আদায়’-এর এক বড় উদাহরণ। কোনও অর্থব্যবস্থা যদি সম্মিলিত ভাবে ভবিষ্যৎ-উদাসীন হয়, তবে কোনও এক সময়ে তার ‘বর্তমান’ বিপন্ন হওয়াও স্বাভাবিক। পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থা সেই ‘বর্তমান’-এ এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন হল, একটা গোটা দেশ এমন সামগ্রিক ভাবে ভবিষ্যৎ-অন্ধ হয়ে উঠল কেন? পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অভাব, এবং দেশ শাসনের প্রশ্নে সেনাবাহিনীর অতি প্রবল হস্তক্ষেপের প্রবণতার কথা বহুচর্চিত। তার প্রত্যক্ষ ফল হল, সে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই— কোনও সরকার আদৌ টিকবে কি না, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে পরের সরকার গঠিত হবে কি না, বর্তমান জমানার নীতি পরবর্তী জমানায় আমূল পাল্টে যাবে কি না, কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর নেই। বিনিয়োগের পক্ষে এমন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। ফলে, হাতে যতটুকু সময় আছে, তার মধ্যেই আখের গুছিয়ে নেওয়া স্বাভাবিক— সেখান থেকেই ‘খাজনা আদায়’-এর প্রবণতার সূত্রপাত। এতে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যেখানে কেউই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। রাজনৈতিক অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা বলবেন, ‘নিম্ন বিশ্বাস’-এর অর্থব্যবস্থা আর্থিক ভাবে পশ্চাৎপদ হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরোক্ষ ফল, ক্রমশ আরও বেশি করে মৌলবাদের দিকে ঝোঁকা, সন্ত্রাসবাদকে জায়গা করে দেওয়া। গণতন্ত্রের অভাবই পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থাকে আজকের সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy