—প্রতীকী ছবি।
খেয়াল করে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যাবে যে, ভুল বোঝাতে গেলে দু’টি পক্ষের উপস্থিতি আবশ্যক— এক পক্ষ ভুল বোঝাবে, অন্য পক্ষ তাতে বিশ্বাস করবে। সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে দেশের শাসকপক্ষের নেতারা সমানেই ভুল বুঝিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে তা একাধিক বার আলোচিত হয়েছে। সামনেই ভোট, ফলে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যভঙ্গের ছবিটি যাতে সাধারণ মানুষের সামনে প্রকট না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে শাসকরা প্রাণপাত চেষ্টা করবেন, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু, তাঁরা বোঝাতে চাইলেই বা সাধারণ মানুষ বুঝবেন কেন, এই প্রশ্নটি করতেই হবে। ভারতের ‘উজ্জ্বল অর্থনৈতিক অবস্থা’র রূপকথায় বিশ্বাস করার আগে তার যাথার্থ্যকে প্রশ্ন করা নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু, কী ভাবে করবেন? মানুষের মনে হতেই পারে যে,
অর্থশাস্ত্রের দুনিয়া খটমট অঙ্ক আর দুর্বোধ্য পরিভাষায় ঠাসা, অর্থাৎ পুরোটাই শিশিবোতল। তা হলে প্রশ্ন করবেন কোথায়? প্রশ্ন করা প্রয়োজন নিজের পরিস্থিতিকে। যেমন, মনে করার চেষ্টা করা দরকার যে, কিছু দিন আগে মাসকাবারি সামগ্রী কিনতে যত খরচ হত, এখন তার চেয়ে কত বেশি খরচ হচ্ছে। আগের চেয়ে কি কম পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন? পরিসংখ্যান বলছে, হ্যাঁ— মানুষের ভোগব্যয় কমছে। ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, এই তিন মাসে সার্বিক ভাবে ভোগব্যয়ের পরিমাণ তার আগের তিন মাসের তুলনায় অনেকখানি কমেছে। নিজের গৃহস্থালির দিকে তাকালেই আসলে দেশের অর্থব্যবস্থার ছবিটি চোখে পড়বে। সেটা দেখে নেওয়া নাগরিকের কর্তব্য।
এ বার প্রশ্ন করা দরকার, ভোগব্যয় কমছে কেন? বিলাসদ্রব্য নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পিছনেও খরচ কমাতে বাধ্য হওয়ার দুটো কারণ থাকতে পারে— এক, যথেষ্ট আয় হচ্ছে না; এবং/অথবা দুই, জিনিসের দাম বাড়ছে। বাজার কতখানি অগ্নিমূল্য, তা বোঝার জন্য কাগুজে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না— প্রতি দিন সকালে বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যায়। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে— গত ডিসেম্বর মাসে দেশে খাদ্যপণ্যের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৯.৩৮%। অর্থাৎ, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১০০ টাকায় যতটুকু জিনিস কেনা যেত, তা কিনতে ২০২৩-এর ডিসেম্বরে খরচ করতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৩৮ পয়সা। জানুয়ারির পরিসংখ্যান বলছে, একেবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, যেমন ধান, ডাল, আনাজ বা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে প্রবল হারে— যথাক্রমে ৯.৫৬%, ১৬.০৬%, ১৯.৭১% এবং ২৯.১৮%। এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো আয়বৃদ্ধি কার্যত কারও ঘটেনি। ফলে, ভোগব্যয়ে লাগাম টানতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ মানুষ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতেই দেশের সিংগভাগ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, এমন পরিস্থিতি তো ভারতের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়ার রূপকথার সঙ্গে খাপ খায় না। কাজেই, সাধারণ মানুষের কর্তব্য হল প্রশ্ন করা— এই যদি আর্থিক উন্নতি হয়, তবে খাবার কেনার সামর্থ্য কোথায়, আর এই যদি অসামর্থ্য হয়, তবে উন্নতি কোথায়?
অর্থনীতির তত্ত্ব আর তথ্যের মারপ্যাঁচে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে দেওয়া সোজা। আবার কঠিনও, যদি মানুষ সেই কথার জালে না জড়িয়ে শুধু নিজের অবস্থাটিকে প্রশ্ন করতে শেখেন। অর্থব্যবস্থার প্রকৃত ছবিটিতে যে মানুষের প্রাত্যহিকতার প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য, এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। সাধারণ মানুষ আগের চেয়ে খারাপ আছেন মানে অর্থব্যবস্থাও সামগ্রিক ভাবে খারাপ আছে— কোনও গল্প, কোনও পরিসংখ্যানই সেই সত্যটিকে পাল্টাতে পারে না। যাঁরা এই বিশ্বাসে স্থিত যে, আজ মন্দির হয়েছে মানে কাল মানুষের ভাল থাকাও নিশ্চিত হবে, তাঁরাও নিজেদের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতে পারেন। তাতে উপকার হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy