Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Fire Cracker Factory

প্রাণের মূল্যে

গ্রামে কাজের সুযোগের অভাব বলেই ছোট-বড় অবৈধ কারখানা, ভেড়ি, ভাটা, বা খাদানে কখনও শ্রমিকের জোগানে অভাব হয়নি। আজও সে ভাবেই কর্মী জোগাড় হচ্ছে।

An image of Fire Crackers

অবৈধ বাজি কারখানার দুর্ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারালেন, তাঁদের মৃত্যুর জন্য দায়ী যতটা বিস্ফোরক, ততটাই দায়ী বেকারত্ব, কর্মহীনতা। প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৩ ০৫:৪২
Share: Save:

এগরা, বজবজ, ইংরেজ বাজারে অবৈধ বাজি কারখানার দুর্ঘটনায় যাঁরা প্রাণ হারালেন, তাঁদের মৃত্যুর জন্য দায়ী যতটা বিস্ফোরক, ততটাই দায়ী বেকারত্ব, কর্মহীনতা। বিশেষত এগরার বাজি কারখানাটিতে একাধিক বিস্ফোরণের ইতিহাস জানা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের মেয়েরা কাজ করতে যেতেন, তার কারণ জীবনধারণের বিকল্প উপায় তাঁরা খুঁজে পাননি। অনেকেই কারখানার মালিক কৃষ্ণপদ বাগের কাছে ঋণ নিয়ে শোধ করতে পারেননি, তাই তাঁর কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁদের ‘বেতন’ থেকে পরিশোধ হচ্ছিল ঋণ। অতএব পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় কী করে বাজি কারখানা চলছিল, এটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়, আরও বড় প্রশ্ন হল, গ্রামে রোজগারহীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছল কী করে, যাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রামবাসী? কেন বাংলার গ্রামে গ্রামে পুরুষ-মহিলা-শিশু এমন মালিক-ঠিকাদারদের কাছে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করছেন, যাঁরা কার্যত মাফিয়া? কৃষ্ণপদ বাগের মতো মানুষ বাংলার একটি রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতিনিধি, যাঁরা আইনের শাসনকে পরাভূত করে, হিংসা ও উৎপীড়নের জোরে এক-একটি অর্থকরী ক্ষেত্রকে কুক্ষিগত করেছেন। কখনও তা কারখানা, কখনও খাদান, বালিয়াড়ি বা ভেড়ি। এলাকার মানুষ প্রাণ হাতে নিয়ে কাজে নামতে বাধ্য হচ্ছেন, তার কারণ এলাকায় আর কোনও কাজ নেই। বাজিতে নিহতদের পরিজন গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার অধীনে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য আক্ষেপ করেছেন সাংবাদিকদের কাছে।

রাষ্ট্র কাজের অধিকার দিয়েছে নাগরিককে, অথচ কেন্দ্র ও রাজ্য পরস্পর সংঘাতে সেই কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে পশ্চিমবঙ্গকে— এ হল আক্ষেপের কথা। ভয়ের কথা এই যে, সরকারি প্রকল্পের কাজটুকুই বহু গ্রামবাসীর কাছে রোজগারের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে। কৃষি, শিল্প, পরিষেবা, কোনও ক্ষেত্র থেকেই গ্রামে নিয়মিত রোজগার মিলবে না, এটাই যেন সকলে ধরে নিয়েছেন। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ রোজগারের আশায় হয় ভিনরাজ্যে চলেছেন, না হলে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে যে কোনও শর্তে, যে কোনও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। খাওয়া-পরার খরচ মেটাতে ঋণ নেওয়া, এবং প্রায় মিনিমাগনা খেটে তা শোধ দেওয়া, এ হল ‘দাসশ্রম’-এর পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় মালিক বা ঠিকাদার যে কাজে নিয়োগ করেন, যা কিছু নির্দেশ দেন, তা মেনে নিতে বাধ্য হন শ্রমিকরা। দুর্ঘটনায় প্রাণ যাবে, দূষণে অসুখ হবে, পুলিশ জেলে ভরবে, জেনেও শ্রমিকরা অসহায়। ফল অঙ্গহানি, মৃত্যু, কখনও কারাদণ্ড, দাগি পরিচয়ে বেঁচে থাকা। অসংগঠিত, অবৈধ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুগুলির অধিকাংশই নথিভুক্ত হয় না, তাই শোরগোলও পড়ে না। এগরা, বজবজের ছিন্নভিন্ন দেহের বীভৎসতা সে দিকে তাকাতে বাধ্য করল।

গ্রামে কাজের সুযোগের অভাব বলেই ছোট-বড় অবৈধ কারখানা, ভেড়ি, ভাটা, বা খাদানে কখনও শ্রমিকের জোগানে অভাব হয়নি। আজও সে ভাবেই কর্মী জোগাড় হচ্ছে। পঁচাত্তর বছরের গণতন্ত্র সে প্রথায় কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে রাজ্যজোড়া অবৈধ বাজির কারখানা। আজ রাজ্য সরকারকে নতমস্তকে স্বীকার করতে হবে, কেবল অনুদানের প্রকল্প দিয়ে দারিদ্র কমে না। গ্রামীণ মজুরি কমছে, অথচ খাবার-সহ সব জরুরি জিনিসের দাম বাড়ছে— এই ভয়ানক পরিস্থিতির মোড় ঘোরানোর জন্য উপযুক্ত সরকারি নীতি চাই। চাষকে লাভজনক করতে ফড়েদের নিয়ন্ত্রণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ, তৃণমূল স্তরে শূন্য পদে সরকারি কর্মী নিয়োগ— উপায়গুলি অজানা নয়। সে সব কর্তব্য এড়িয়ে, আইনের শাসনকে শিথিল করে ‘মানবিক’ মুখ দেখাতে চান নেতারা। খাওয়া-পরার সংস্থান করছে, এই অজুহাতে অবৈধ ক্ষেত্রকে ছাড় দিলে গরিব আরও বিপন্ন হয়। রাজনীতি ও প্রশাসনকে এই কথাটি স্বীকার করতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE