দমদমের শ্রাবন্তী, বসিরহাটের সুপর্ণা বাপের বাড়ি ছাড়িবার কয়েক মাস পরেই পৃথিবী ছাড়িল। অপঘাতে মৃত তরুণী বধূদের যে তালিকা নিরন্তর লিখিতেছে এই দেশ, যেখানে প্রতি বৎসর অন্তত আট হাজার মেয়ের নাম উঠিয়া থাকে, এখন সেখানে খোঁজ মিলিবে শ্রাবন্তী-সুপর্ণার। জন্ম হইতে ইহারা দৃশ্যত ছিল বাবা-মায়ের নয়নের মণি। কন্যাকে পড়াইতে পরিবার কষ্ট সহিয়াছে। মেয়েরাও কেহ স্বভাবের মাধুর্যে, কেহ মেধার ঔজ্জ্বল্যে আশেপাশের মানুষের মুগ্ধতা আদায় করিয়াছে। অথচ বিবাহের পর অচিরে তাহারাই শ্বশুরবাড়িতে বিরক্তি ও উপহাসের পাত্র হইয়াছে। কোনও মেয়ে আশানুরূপ বরপণ আনিতে পারে নাই, কেহ গৃহকর্মে যথেষ্ট পারদর্শী নহে। কেহ দেবর-শ্বশুরের প্রস্তাবে অসম্মত হইবার স্পর্ধা দেখাইয়াছে, কেহ মাতাল স্বামীর মার খাইয়া বাপের বাড়িতে নালিশ করিয়াছে। কেহ কৃষ্ণবর্ণ, কেহ খর্বকায়, কাহারও সন্তান হয় নই, কাহারও কন্যাসন্তান হইয়াছে। মোটের উপর তাহারা সংসারে অচল, বিদায় হইলেই ভাল। অপমানের কারণ তুচ্ছ হইতে পারে, উদ্দেশ্যটি মারাত্মক, বধূর আত্মবিশ্বাস ধূলায় মিশাইয়া দেওয়া।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র শ্রাবন্তী-সুপর্ণার মতো একবিংশের মেয়েদের আশৈশব বুঝাইয়াছে, পুরুষ-মহিলায় প্রভেদ নাই। লেখাপড়া, স্বরোজগারই সম্মানের উৎস। মেয়েরাও প্রাণপণে পরীক্ষার নম্বর কুড়াইয়াছে। হাতের কাজ, টিউশন, চাকরি করিয়া টাকা জমাইয়াছে। কিন্তু বিবাহ হইতে না-হইতে এই মেয়েরা বুঝিয়াছে, তাহার সকল ডিগ্রি, দক্ষতা বাতিল নোটের শামিল। তাহার জীবনসঙ্গীও তাহাকে দুইটি হাত এবং একটি গর্ভের অধিক ভাবিতে রাজি নহে। সংসারে থাকিতে হইলে তাহাকে অসম্মানের শর্তে, উনমানব হইয়া বাঁচিতে হইবে। টেলিভিশনের বাংলা সিরিয়াল জনপ্রিয়, কারণ তাহাতে বাঙালি সংসারের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন মেলে। সেই সব কাহিনিতে নববধূকে বোঝানো হয়, সে নূতন সংসারের উপযুক্ত নহে। অতঃপর বধূর উপযুক্ত হইবার লড়াই শুরু হয়। কাহিনির গতি হইবার প্রয়োজন ছিল বিপরীত। অধিকাংশ বাঙালি পরিবার এখনও শিক্ষিত, মর্যাদাময়ী মেয়েদের উপযুক্ত হইতে পারে নাই। সাবেকি সংসার উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী তরুণীকেও গৃহপরিচারিকা তথা সন্তানের আয়া করিয়া তোলে। দেহ, শ্রম, প্রেম, ভক্তি-বাৎসল্য, যাহা কিছু একটি মেয়ে নিজস্ব বলিয়া দাবি করিতে পারে, তাহার স্বত্ব দখল করে পরিবার। নিঃশর্তে, নিঃশুল্কে। তাই বধূর বই পড়িবার ইচ্ছা এত বিপজ্জনক। বই পড়িলে চিন্তা স্বাধীন হয়। বই কি মেয়েদের পড়িতে আছে?
বই পড়িতে পারেন নাই শ্রাবন্তী। তাঁহার দিনলিপি বঙ্গনারীর আত্মকথার এক দীর্ঘ ধারায় তাঁহাকে স্থান দিয়াছে। দেড়শো বৎসর বহিতেছে এই ব্যথার ফল্গুধারা। তাহার মধ্যে কত না বাঙালি বধূর অকালমৃত্যু হইয়াছে। এই সময়কালে স্বাধীনতা সংগ্রাম, দুই বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা-দেশভাগ মিলাইয়া সম্ভবত অত মানুষ মরে নাই। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে এই মেয়েরা কোথায়? নকশালবাড়ি বা মরিচঝাঁপির ঘাতকদের বিচার চাহিয়া আজও স্লোগান ওঠে, শ্রাবন্তী-সুপর্ণাদের জন্য রাস্তায় নামিবার, কলম ধরিবার, থানা-আদালত করিবার লোক নাই। পুকুরের তলদেশ হইতে, গাছের ঝুলিয়া-পড়া ডালটি হইতে, হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ড হইতে শত সহস্র মেয়ে নীরবে বলে, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy