আরে বাপু, আমি ভরত মেটিরিয়াল। রাম বনবাসে গেলে তাঁর খড়ম সিংহাসনে রেখে পুজো করি। কেউ আমাকেই সিংহাসনে বসতে বললে, আওড়াই: হেঁ-হেঁ! রাজনীতির কেরিয়ারের গোড়ায় আম্মার বিরুদ্ধে ছিলাম বটে, কিন্তু তার পর হাওয়া বুঝে পাল্টি খেয়ে, একেবারে তাঁর পায়ের তলায় ভক্তচূড়ামণির সিটখানি পাক্কা! স্টেজে উঠে আম্মাকে হাপুস হয়ে গড় করেছি। ওঁর হেলিকপ্টার তখনও নামেনি, ভোঁ-ভোঁ করছে, তার আগেই সাষ্টাঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়েছি। হ্যাঁ, লাখ লাখ লোকের সামনে। নিন্দুকে কত কী বলেছে। কী এসে যায়! আমি যে ভক্তিভাবে সাধনা করছি, দাস্যভাবে ডক্টরেট হয়েছি, সেবাভাবে দীক্ষা নিয়েছি!
আম্মাও অচলা ভক্তির প্রাইজ দিয়েছেন। কত্ত বার মন্ত্রী তো করেছেনই, সবচেয়ে বড় কথা, যত বার উনি কোর্টের রায়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরেছেন, তত বার আমি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছি। কিন্তু মুখ্য হইনি। উঁহু। জানি তো, আমি এই নকশি-কাঁথায় প্রক্সিম্যান। দ্বিতীয় বার তো মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার শপথ নেওয়ার সময়ও কেঁদে ভাসিয়েছি। এ বার যখন উনি একেবারে ভবলীলা শেষ করে চলেই গেলেন, তখনও আমি মুখ্যমন্ত্রী। তার পর চিন্নাম্মা বললেন, উনি কুর্সি নেবেন। আমায় ডেকে রীতিমত হুমকি দেওয়া হল, সরে যা! একে আম্মার সখী ছিলেন উনি, মরদেহ আগলে রেখেছিলেন অন্ত্যেষ্টির সময়, তার ওপর হুকুম শুনলেই তক্ষুনি তা পালনের একটা রিফ্লেক্স আমার মধ্যে গাঁথাই আছে। চটাং ইস্তফা দিয়ে দিলাম। চিন্নাম্মাকে কেমন পোজে প্রণাম করব, সম্ভব হলে হেলিকপ্টার ছাড়ারও আগে থেকে, রিহার্সাল দিচ্ছিলাম।
তার পর চকিত সংবাদ শুনি, চিন্নাম্মাকে আবার সেই কেসে কাঠগড়ায় তোলা হবে, যাতে উনি, আম্মা, আরও অনেকে ফেঁসেছিলেন! সুড়সুড়িয়ে মনে হল, আরে! যদি তালেগোলে কোনও আম্মাই না থাকেন, তবে খেলা জিতবে কে? রাম যদি বলতেন সব ছেড়েছুড়ে হল্যান্ড চললুম রে! তখন ভরতের কী মনে হত? দুটো এক্সএল সাইজ জুতো সিংহাসন থেকে ছুড়ে ফেলে ভরত কি ঘোষণা করতেন না, এ বার নো খড়ম, ওনলি আমিই পরম, আমিই চরম? আমার হল সেই দশা। এক বার মনে হয়, এত বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছি, আম্মাকে এমন পুজো করেছি, ভক্ত বর পাবে না তো কে পাবে? তার পরেই ভেতর থেকে কে কাছাকোঁচা টেনে ধরে বলে, যাসনি বাপ, ও দিকটা তোর এরিয়া না। ক্ষমতা অতি গুরুপাক, পেট ছেড়ে দেবে।
সত্যিই তো, চিরকাল কাউকে খুঁজে এসেছি, যাকে তুষ্ট করে ধন্য হব। নিজেকে কী করে তুষ্ট করতে হয়, অ্যাম্বিশনপুষ্ট করতে হয়, পরিস্থিতিদুষ্ট করতে হয়, তা তো জানি না! পাগল-পাগল লাগছিল। পরধর্মে পোঁওও লং জাম্পিয়ে বসে পড়া কি সুবিধের হবে? এ দিকে নোলাও সুপার-সকসক! আর কখনও পেন্নাম ঠুকে মাজা ব্যথা করতে হবে না! বরং অন্য কে পেন্নাম যথাযথ কমপ্লিট করল না, বিচ্ছিরি হাতের লেখায় তার নোট রাখব! কেনই বা নয়? আমি যে নীচে থেকেছি, তার কারণ আমি নিজ উঁচাইকে রেসপেক্ট করিনি। মোটিভেশনের বই পড়ার পর প্রথম পাঁচ মিনিট যেমন হয়, তেমন একটা ধড়াস ধড়াস কনফিডেন্স এসে গেল। আম্মার জয় বলেই জিভ কেটে শোধরালাম: ‘আমার’ জয়! অলৌকিক প্রিন্টিং মিসটেক।
আম্মার সমাধির সামনে সিধে শিরদাঁড়ায় ধ্যানে বসে গেলাম রাত্তির ন’টায়। যায় কোথায়? সাংবাদিক, পাবলিক, সব হুড়িয়ে হাজির। বললাম, আম্মার আত্মার নির্দেশ পেলাম, আমিই মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই ফের। অ মা, দেখি আত্মাকে নো পাত্তা! পৃথিবী কি তবে আত্মায় চলে না, এমনকী মেলোড্রামাতেও নয়? জাস্ট টাকায় চলে! চিন্নাম্মার গাদা গাদা টাকার লোভে সবাই আম্মার পবিত্র আত্মাকে হোলসেল অস্বীকার করলে! বন্ধুরা বলল, দাঁড়া না, মহিলা যেই জেলে যাবেন, সব সুড়সুড়িয়ে তোর পেছনে এসে দাঁড়াবে। কয়েদির আবার ক্যারিশমা হয়? অ মা, দেখি, দিব্যি হয়! চিন্নাম্মা কয়েদ হলেন, আর সব্বাই বললে, উফ, কোন বড় মানুষটা জেলে যায়নি শুনি! আঃ, তবু কী গ্ল্যামার! কী দেওন-থোওন! নারীপুুজোর দেশে হোঁতকা পুরুষের দিকে যাব, ছেঃ!
এ বার কী হবে? আম, ছালা, চাবি, তালা, সবই গেল! এখন মনে হচ্ছে, ‘সকলেই সব পারে, প্রত্যেকের মধ্যেই সিংহ আছে, জাস্ট আলজোলাম খেয়ে ঘুমুচ্ছে, ওকে ন্যাজ ধরে চাগিয়ে তোল!’ যারা লেখে, সেরেফ বিক্রির জন্যে ধাপ্পা দেয়। ধর্মগ্রন্থে এমন বাণী হইহই লাফায়, কারণ তাতে যা-ই লিখুক রিভিউ বেরবে না। আর বিপ্লবীরা এ ভাঁওতা দেয়, কারণ তা নইলে গুলির সামনে ঝাঁপাবার মতো যথেষ্ট গরিব পাবে কোথায়?
তবে কি উঁচা-ছোঁচা ভাগ সত্যিই আছে, বস-এর চেয়ারে বসতে গেলে জন্মকেরানি পেছন শিউরে শক খায়? এবং সুষ্ঠু যাপন মানে হল, নিজের সাধ্য ও প্রবণতাকে খুবসে হিসেব কষে নিয়ে, সেই চৌকাঠের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে দাবড়ে বেঁধে রাখা, সে যতই ঘৌ-ঘৌ করুক না কেন? না কি, এগুলো হল নিরাপদ মিনমিনে-র ম্যানিফেস্টো, আসলে সাহসই প্রতিভা? আত্মাম্মার কাছে ধ্যানে মুন্ডু না নুইয়ে, নিজের দাপটে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে যদি পারতাম, আজ ইতিহাস অন্য হত? না কি, এ সব কিস্যু নয়, রেজিগনেশনটা না দিলেই ডামাডোল অ্যাদ্দূর গড়াত না? ক্ষমতা হাতে পেয়ে কক্ষনও স্বেচ্ছায় ছাড়তে নেই? না কি, এক বার ছাড়লে ফের ধরার লাফ আর দিতে নেই? তেলচুকচুকে বাঁদরের মতো তিন পা সিলিপ কেটে ছ’পা এগোনোর ফর্মুলা একদম বকওয়াস? বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, নিচু জীবনধারার ছাপ নিম্ন চেতনাকে গড়ে, সারা জীবন বেঁকে ছিলাম, এ বার সোজা হতে গিয়ে নিজের কাছেই বেঢপ ঠেকছে। শুধু হাত চলে যাচ্ছে নিজের মাথায়, মুশকিল-আসান খড়মের একটি চটাস-গাঁট্টা খুঁজতে!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy