Advertisement
১৫ জুন ২০২৪

রোজকার যাপনের মাঝে ভেসে যায় কবিতার সুর

কিন্তু এই কবিতাচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না অনেকেরই। পরবর্তীতে অনেককেই আক্ষেপ করতেও শোনা যায়— এক কালে অনেক কবিতা করেছি, এখন আর ওসব আসে না।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৫
Share: Save:

এ কটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে (পড়ুন যৌবনে) কবিতা লেখেননি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই কবিতাচর্চার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না অনেকেরই। পরবর্তীতে অনেককেই আক্ষেপ করতেও শোনা যায়— এক কালে অনেক কবিতা করেছি, এখন আর ওসব আসে না।

মহিলাদের ক্ষেত্রে তো সব ওই বিয়ের পরেই চুকে যায়। বেশ কিছু গৃহকর্ত্রীর মুখে এ হেন যন্ত্রণার কথা শোনা যায় যে— সব ওই রান্নাঘরের নালি দিয়েই বয়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু কবিতার জন্যই যে শুধু জীবনধারণ সম্ভব, এটারই প্রমাণ দিল ‘অরণ্যে ভেসে যায় কবিতার সুর’ শীর্ষক কবিতা উৎসবটি।

বেথুয়াডহরি অভয়ারণ্যের বেদুইন যাত্রীনিবাসের সামনের বাগানে ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ হয়ে গেল এমনই এক অভিনব উৎসব। সারাদিন ব্যাপী কবিতার সঙ্গে যাপন। অথচ, অনুষ্ঠানে কোথাও এতটুকু একঘেয়েমি নেই। সারা বাংলা থেকে এসেছিলেন বেশ কিছু কবি। কবিতার প্রতি অকৃত্রিম আবেগই এ ধরনের অনুষ্ঠানের মূলে। কবি সুকান্ত খিদের জ্বালায় আর্থিক অনটনে কবিতাকে ছুটি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সার্বিক সহযোগিতা পেলে আর্থিক অসঙ্গতি অনেকটাই কাটানো সম্ভব বলে জানালেন সংগঠকদের এক জন। এবং সত্যিই বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই অনুষ্ঠানে সাড়া দিয়ে এসেছেন। শুনিয়ে গিয়েছেন কবিতা। শুনেছেন অন্যের কবিতা। সঙ্গে ছিল বনভোজনের আনন্দ।

গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এই ‘অরণ্যে ভেসে যায় কবিতার সুর’ কবিতা উৎসবের সূচনা। গত বার ৬০ জন কবির সম্মেলন হয়েছিল। এবারে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। এটা আশাব্যঞ্জক। আসলে গত বছরের ব্যাপক সাফল্যই এই বছরে আবার উদ্যোগ গ্রহণের কারণ।

মূলত বেথুয়ার চারটি লিট্ল ম্যাগাজিনের উদ্যোগেই এই উৎসব। সম্পাদকগণ অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ হেন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ‘চেতনা’, ‘বনামি’, ‘সৌপ্তিক’ ও ‘কথাকৃতি’ পত্রিকার সম্পাদকগণ যথাক্রমে চপল বিশ্বাস, দিলীপ মজুমদার, পার্থসারথি চৌধুরী এবং নীলাদ্রিশেখর সরকার প্রমুখ দ্বারা এই মহান কর্মযজ্ঞের আয়োজন।

অনুষ্ঠানের আকর্ষণের কেন্দ্রে কবিতা তো আছেই সঙ্গে রয়েছে অরণ্যপ্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। এক দিনের জন্য আরণ্যক জীবনের দুর্নিবার আনন্দ। যেন কিছুটা শিকড়ে ফিরে যাওয়া। মানুষ তো পূর্বে অরণ্যচারীই ছিল। ক্রমে মানুষ অরণ্য কেটে সভ্যতা গড়েছে। কিন্তু সেই অরণ্যপ্রকৃতি মানুষকে আজও কী ভাবে আকর্ষণ করে, তা বোঝা গেল দূরদূরান্ত থেকে আসা কবিদের দেখে। কলকাতা থেকে বেশ কয়েক জন কবির মধ্যে এসেছিলেন কেতকীপ্রসাদ রায়। কলকাতা লিট্ল ম্যাগাজিন ফোরামের সম্পাদক কেতকীবাবু তো বলেই দিলেন, ‘‘ফরেস্টের উন্মুক্ত পরিবেশে কবিতাপাঠের সুযোগ ছাড়তে পারলাম না।’’ শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাই চলে এসেছেন।

কবিতা ও অরণ্য যেখানে এক হয়ে যায়, সেখানে সৃষ্টিশীল মানবসত্তা কী করে ঘরের কোণে মুখ লুকোন! বহরমপুর থেকে তাই চলে এসেছিলেন চুরাশি বছরের কবি ও সম্পাদক উৎপল গুপ্ত। এই বয়সে নানান শারীরিক সমস্যা নিয়ে সেই অমোঘ আকর্ষণেই তাঁর আগমন। এসেছিলেন বর্ষীয়ান কবি অরুণকুমার চক্রবর্তী। কবিতা শিল্পকে আশ্রয় করে বাঁচার কথা বলেন তিনি।

বেদুইন যাত্রীনিবাসের সামনের অঙ্গনে খোলা আকাশের নিচে সারা দিন ধরে চলে নানান স্বাদের কবিতা। চলে শ্রুতিনাটক। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র তথা উপস্থাপনার নৈপুণ্যে প্রতিটি প্রয়োগ ভাবনাই ছিল উপভোগ্য। সঙ্গে চলতে থাকে চিত্রশিল্পী চন্দন দাশের ছবি আঁকা। জীবনের চলমানতাই ছিল তাঁর ছবির বিষয়। কবিদের কবিতাতেও ছিল চলার ছন্দ। কবিতার ভাষা ও ছবির ভাষা এ ভাবেই এক হয়ে যায়। যা ওই অনুষ্ঠানকে বিশেষ গতি দিয়েছে, সন্দেহ নেই।

কবিতা কী ভাবে মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা হতে পারে, তা আরও ভাল করে বোঝা গেল কল্যাণী থেকে আসা হিমাংশুভূষণ বালোর সঙ্গে কথা বলে। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, একাকী। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এক নৈরাশ্যপীড়িত করুণ জীবনেই নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই লিট্ল ম্যাগাজিনগুলির প্রেরণাতেই লেখালেখি শুরু করেন। বর্তমানে কবিতা ছাড়াও গল্পগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। বললেন, ‘‘বর্তমানে আমার মতো সর্বহারার জীবনের অবলম্বন এই কলমটাই।’’ লেখার মাধ্যমেই প্রতিনিয়ত হতাশা কাটিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

বর্তমান প্রজন্মের শংকর মজুমদার, তাপস চক্রবর্তী, দেবাশিস মিত্র, দীন মহম্মদ শেখ, সাথী মণ্ডল প্রমুখের কবিতা মন ছুঁয়ে যায়। সাথীর শারীরিক দুর্বলতা তাঁর মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি এতটুকুও। জানালেন, এই শক্তিও তিনি পেয়েছেন কবিতা থেকেই।

এই কবিতা উৎসবে বিশেষ মাত্রা যোগ করে দু’টি শ্রুতিনাটক। একটি বনানী মুখোপাধ্যায় রচিত ‘এ কোন সকাল’— অভিনয়ে দীপাঞ্জয়ী ভট্টাচার্য ও সমৃদ্ধ উকিল। আর একটি অমল রায় রচিত ‘বড় একা লাগে’—- অভিনয়ে নন্দিনী লাহা। দু’টিতেই বর্তমান সমাজের মানুষের একাকিত্ব তথা গণ্ডিবদ্ধ মানসিকতার ছবি। আত্মসর্বস্বতাও এ সমাজের বড় ক্ষত। যা শ্রুতিনাটকে ফুটে ওঠে।

এই উৎসবে সরস্বতীর এত জন বরপুত্র তথা পুত্রীদের আগমনের পিছনে যাঁদের অবদান, তাঁরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত রয়েছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে লিট্ল ম্যাগাজিন চালাচ্ছেন বহু বছর ধরে। আবার, তাঁদের আহ্বানে এ রকম বেশ কয়েক জন পত্রিকা সম্পাদক এসেছিলেন এখানে। যেমন সুমন বিশ্বাস। শিশু-কিশোরদের জন্য ‘বিহানবেলা’ নামে একটি পত্রিকা করেন৷ পাশাপাশি, ‘পল্লীবীক্ষণ’ পত্রিকাটিও সম্পাদনা করেন।

উৎসবের বিশেষ চমকটি ছিল শেষে। আমরা দেখি, নতুন সাহিত্য প্রতিভাদের পাদপ্রদীপের আলোয় আনা পত্রিকাগুলি। সেগুলির ঝাঁ চকচকে মলাটের পিছনে সম্পাদকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। পাঠকের সামনে নব নব বিষয় ভাবনা তুলে ধরার প্রয়াস তাঁদের। যাঁরা আয়োজন করেছেন ‘অরণ্যে ভেসে যায় কবিতার সুর’। কিন্তু তাঁদের পরিবারের স্ত্রীলোকদের যে অনুপ্রেরণা তথা স্বার্থত্যাগ, সেই খবর ক’জন পাঠক রাখেন! তাই সেই সকল মহিলাদের (মা কিংবা স্ত্রী) ‘সৃষ্টির অন্তরালে প্রণোদিত সম্মান’ নামে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হল। প্রেরণাদাত্রী অথচ সংসারের অন্তরালে থাকা নারীদের এ ভাবেই সম্মান জানিয়েছে এই কবিতা উৎসব। যেখানে যুক্ত হয়েছে মানবতার সুর।

শ্রীপৎ সিংহ কলেজের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Forest Poem Festival Bethuadohori Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE