বাপের বাড়ি ফিরিয়া এক নববধূ সলাজ অহঙ্কারে জানাইয়াছিলেন, তাঁহার ট্র্যাফিক কনস্টেবল স্বামীর এমনই ক্ষমতা যে এক বার হাত তুলিয়া তিনি স্বয়ং লাটসাহেবের গাড়িও থামাইয়া দিতে পারেন। সেই স্বামীটির যদি একটি সরকারি মোটরসাইকেল থাকিত, তবে হয়তো বধূর অহঙ্কারের তালিকা আড়েবহরে বাড়িত— তিনি বলিতে পারিতেন, তাঁহার স্বামীকে সিগনালে দাঁড়াইতে হয় না, তাঁহার মোটরসাইকেলে হেলমেট পরিবার বাধ্যবাধকতা নাই, তিনি নো এন্ট্রিতে ঢুকিতে পারেন, একমুখী রাস্তায় দিব্য বিপরীত মুখে গাড়ি চালাইয়া দিতে পারেন, যত্রতত্র পার্কিং-এও বাধা নাই। ইহা যদি ক্ষমতা না হয়, তবে আর ক্ষমতা কাহাকে বলে? কলিকাতার রাজপথে পুলিশকর্মীরা হরহামেশাই এমন ক্ষমতার পরিচয় দিয়া থাকেন। ক্ষমতা বস্তুটি চরিত্রে নববধূর গহনার ন্যায়— লোককে না দেখাইতে পারিলে তাহার প্রকৃত স্বাদ টের পাওয়া যায় না। কলিকাতার রাজপথের আইনরক্ষকরা ডাইনে-বামে আইন ভাঙিয়া ক্ষমতার স্বাদটি উপভোগ করিয়া থাকেন।
‘আপনি আচরি ধর্ম’-মার্কা নীতিকথা সম্ভবত পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত নহে। নচেৎ, যে কারণে পুলিশ সার্জেন্টরা নাগরিকদের শাসন করিয়া থাকেন, নিজেরা ঠিক সেই কাজগুলি করিতে তাঁহারা দ্বিধা করেন না। প্রশ্ন করিলে উত্তর পাওয়া যাইবে, কর্তব্যরত পুলিশের পক্ষে সব ট্র্যাফিক নিয়ম মানিয়া চলা সম্ভব নহে, তাহাতে অপরাধী হাত ফসকাইয়া যাইবে। কলিকাতার রাস্তায় সব পুলিশকর্মী সর্ব ক্ষণ অপরাধীদের তাড়া করিয়া ফিরিতেছেন, শুনিলে জেমস বন্ড-এর ছবিসদৃশ উত্তেজনা বোধ হয় বটে, কিন্তু কথাটি সত্য বলিয়া প্রত্যয় হয় না। আর, হেলমেট পরিয়া বাইক চালাইলে কেন অপরাধী ফসকাইয়া যাইবে, বোঝা যায় না। আসল কথা, আইন মানিলে ক্ষমতার প্রদর্শনী হয় না। সাধারণ মানুষকে বুঝাইয়া দেওয়া যায় না যে উর্দিধারীরা, তাঁহাদের উর্দির মাহাত্ম্যেই, অ-সাধারণ। অথবা, এই আইনহীনতাই অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে— পুলিশের চাকুরির বেতন-অতিরিক্ত সুবিধা, যাহাকে পার্কস বলা হইয়া থাকে, পথের আইনকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিবার ‘অধিকার’ আসলে তাহাই। মোট কথা, ট্র্যাফিক আইন বলিয়া কোনও বস্তু যে আদৌ আছে, ট্র্যাফিক পুলিশ কর্মীদের দেখিয়া তাহা বুঝিবার উপায় নাই।
লালবাজারের কর্তারা স্থির করিয়াছেন, নিয়ম ভাঙিলে পুলিশকর্মীদেরও জরিমানা দিতে হইবে। উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু জরিমানাটি করিবে কে? এক পুলিশকর্মী অপর কোনও পুলিশকর্মীর নামে চালান কাটিবেন, এতখানি কল্পনা করিতে বেশ সাহস লাগে। ভরসা সিসিটিভি— কিন্তু সেই পথেও নিশ্চয়ই ছিদ্র খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। বরং, সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করিয়া দেখা যাইতে পারে। আইন ভাঙা যে পুলিশের অধিকার নহে, বরং তাহা নিদারুণ অগৌরব, এই কথাটি পুলিশকর্মীদের বুঝাইয়া বলা প্রয়োজন। যাহার উপর কোনও বাহিরের নজরদারি নাই, তাহার কাজ কঠিনতর, নিজেকে নিজে পাহারা দিতে হয়। রাজপথের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁহাদের, নিজেদেরও সেই আইনের সীমারেখায় রাখিবার কাজটি তাঁহাদেরই করিতে হইবে। জরিমানা দ্বিতীয় স্তরের ব্যবস্থা হইতে পারে, কিন্তু প্রাথমিক প্রয়োজন এই সচেতনতার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy