Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
রবীন্দ্রনাথের গানে রাজত্বের আদর্শ ভাবনা, দাসত্বের সমালোচনা

কেন আমরা সবাই রাজা

গানটির প্রথমেই তিনটি অমোঘ শব্দ, ‘আমরা সবাই রাজা’। কোনও সামন্ততান্ত্রিক কল্পনা নয়, ঘোষণাটির মধ্যে সাম্যভাব ও গণতান্ত্রিক চেতনা মিলেমিশে আছে— ‘আমরা সবাই রাজা’।

অঙ্গীকার: ‘মোদের খাটো করে রাখেনি কেউ কোনও অসত্যে।’ রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

অঙ্গীকার: ‘মোদের খাটো করে রাখেনি কেউ কোনও অসত্যে।’ রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৮
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের অতি পরিচিত একটি গান আমাকে অনেক দিন ধরে ভাবায়, ‘আমরা সবাই রাজা’। ১৩১৭ সালে রচিত ‘রাজা’ নাটকে গানটি ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী কালে ‘রাজা’র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ ‘অরূপরতন’ নাটকেও গানটি রেখে দেন রবীন্দ্রনাথ। অনেক সময়ই মনে হয়েছে, এই গানটিতে যেন রবীন্দ্রনাথ রাজত্ব বা ‘রুল’ নিয়ে তাঁর আদর্শগুলি সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমার শিক্ষকস্থানীয় মানুষ শ্রীরণজিৎ গুহ প্রায়ই বলতেন, মার্কসের যেমন ‘গ্রুন্দরিস’ (মূলতত্ত্ব), রবীন্দ্রনাথের তেমনই ‘গীতবিতান’। ওটাই তাঁর সমস্ত চিন্তার ডায়রি বলা যেতে পারে। সেই কথার সূত্র ধরেই গানটির সম্বন্ধে কিছু ভাবনা পেশ করছি।

গানটির প্রথমেই তিনটি অমোঘ শব্দ, ‘আমরা সবাই রাজা’। কোনও সামন্ততান্ত্রিক কল্পনা নয়, ঘোষণাটির মধ্যে সাম্যভাব ও গণতান্ত্রিক চেতনা মিলেমিশে আছে— ‘আমরা সবাই রাজা’। কিন্তু অবস্থাটা নৈরাজ্যের নয়। এমন নয় যে সবাই নিজেকে রাজা মনে করে যথেচ্ছাচার করছেন। কারণ সবাই রাজা হওয়া সত্ত্বেও এক জনই রাজা: ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ কিন্তু রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক এখানে শর্তসাপেক্ষ: ‘নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’ ‘স্বত্ব’ কথাটির অর্থ অধিকার। কিছুটা সার্বভৌমত্বেরও আভাস দেয় কথাটি। এখানে স্বত্ব প্রায় শর্তই। সকলেরই রাজা হওয়ার হক না থাকলে রাজার সঙ্গে মেলার স্বত্ব থাকে না। তাই ‘নইলে’ কথাটির প্রয়োগ। যেন অধিকার-তত্ত্বের সঙ্গে টমাস হব‌্স বা জন লক-এর কনট্র্যাক্ট থিয়োরিরও খানিকটা মেলালেন রবীন্দ্রনাথ। রাজা-প্রজার সম্পর্ক সচরাচর চুক্তি বা শর্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। রাজা প্রজাপালক, প্রায় পিতার মতো। চলতি কথায় আমরা যাকে বলি, ‘হুজুর মা-বাপ’। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় যে দেশে ‘আমরা সবাই রাজা’ হতে পারি, সেখানে একসঙ্গে সকলের রাজা হওয়ার ও রাজ্যে নৈরাজ্য না-আনার জন্য দুটি শর্ত যুগপৎ পূরণ হওয়া প্রয়োজন, ১) এক জন ‘রাজা’ থাকবেন, ২) কিন্তু তিনি রাজা হবেন শুধুমাত্র এই শর্তেই যে আমরাও সবাই রাজা হব। রাজা নিজেও এই নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারেন না।

এই রাজা তবে কে? ইনি কি রাষ্ট্র বা আমাদেরই গড়া রুল অব ল’? অর্থাৎ একটি আইনি বা সাংবিধানিক শাসন সবাই মিলে সৃষ্টি করছি ও মেনেছি বলেই সে-মোতাবেক আমাদের সবার রাজত্ব? এই রাজা কি তবে রুসো বর্ণিত ‘জেনারেল উইল’? রাজার কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কেমন রাজা? না, এমন রাজা, যাঁর রাজত্বে আমরা নিশ্চিত জানি ‘আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে।’ অর্থাৎ, এই রাজার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটি ত্রাসেরও নয়, দাসত্বেরও নয়। পশ্চিমি চিন্তায় ‘দাসত্ব’ ও ‘স্বাধীনতা’র আইডিয়া দুটি বৈপরীত্যের সূত্রে পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা। তাদের দুই মেরুতে রেখে পশ্চিমি রাজনৈতিক চিন্তা এগিয়েছে। এই গানেও তা-ই। আমরা রাজার দাস নই, তাঁর শাসন ভিত্তি ত্রাস নয়, এই কথাটা বলে স্বাধীনতার একটি পরিচিত তত্ত্বেরই আভাস দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রাজা ও প্রজা-রাজার সম্পর্কের অন্য একটি বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রজা(-রাজা)রা অঙ্গীকারবদ্ধ যে, তাঁরা কেউ ‘বিফলতার বিষম আবর্তে’ মারা পড়বেন না। রাজাও প্রজাদের ‘খাটো করে রাখেননিকো কোন অসত্যে।’ ‘অসত্য’ ও ‘বিফলতা’— এই কথাগুলি কী ভাবে বুঝব? অসত্য কেন মানুষকে ‘খাটো’ করবে? কী অর্থে? যিনি ‘খাটো’ নন, তিনি কেমন? মনে হয় এখানে সত্যের সঙ্গে ব্যক্তি-মানুষের বিকাশের সম্পর্কের কথা তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনিই ‘খাটো’ নন, যিনি বিকাশশীল মানুষ। অর্থাৎ, যে মানুষ নিজেকে স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করে এবং অন্যের বিকাশ ও স্বাধীনতার শর্তকে লঙ্ঘন না করে বাঁচতে পারেন। বলা যেতে পারে যে, তাঁর ব্যক্তিত্বকে খর্ব করা হয়নি। এর সঙ্গে সত্যের কী সম্পর্ক? এই প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায়, যদি ‘অসত্য’ কথাটিকে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব চিন্তার দিক থেকে অনুধাবন করি। ‘সত্য’ বলতে এখানে ধ্রুব কোনও সিদ্ধান্ত বুঝলে ভুল হবে মনে হয়। যে কোনও অনুসন্ধানের শেষে আমরা একটি সাময়িক ‘সত্যে’ পৌঁছতে পারি, কিন্তু কোনও সত্যই তো আর শেষ সত্য হতে পারে না। যদি তা কেউ মনে করেন, সেটা গোঁড়ামি। ফলে সত্য বলতে এখানে যুক্তির, পরীক্ষার, বিচারের স্বাধীনতা বলেই ধরতে হবে। এই স্বাধীনতার অভাবই সেই ‘অসত্য’, যা আমাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব খর্ব করে আমাদের বিকাশকে ব্যাহত করে আমাদের ‘বিষমতার বিফল আবর্তে’র মধ্যে ঠেলে দেয়। এখানেও একটি পশ্চিমি চিন্তার সাক্ষাৎ পাই। মার্কসের ১৮৪৪ সালের সেই বিখ্যাত ‘ইকনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস’ বা জন স্টুয়ার্ট মিল থেকে শুরু করে আমাদের সময়ে অমর্ত্য সেনের তত্ত্বের কথা মনে পড়বে। তা হলে দাঁড়াল, এই রাজার রাজত্বটি এমন যে, আমার যুক্তি-বিচার বা সত্যানুসন্ধানের পথে কোনও বাধা নেই।

এ বারে গানটির মধ্যে বিধৃত শেষ চিন্তাটিতে আসি। এই গানের রাজা যেন এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে ‘আমরা’ অর্থাৎ, (রাজা-)প্রজারা এসে রাজার সঙ্গে মিলতে পারি। ‘আমরা যা খুশি তাই করি’, এমনকী চলিও ‘আপন মতে’, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, আমরা তাঁর ‘খুশিতেই চরি’ ও তাঁর পথেই এসে মিলিত হই। আমাদের স্বাধীনতা ও রাজার নিয়মের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। যেন আমাদের স্বাধীনতাতেই তাঁর ইচ্ছের পরিপূরণ এবং নিয়মের সার্থকতা। অথচ গানটি এ কথাও জানিয়ে দেয় যে, মিলিত হলেও আমরা ও রাজা এক নই। রাজা আমাদের কোনও সাধারণ সত্তা নন। রাজা এখানে মানুষের সমষ্টিও নন। কারণ গানটিতে যাঁরা ‘আমরা’, তাঁরা ও রাজা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে কাজ করেন। ‘আমরা’ যাঁরা, তাঁদের স্বত্ব ও উপরে আলোচিত অর্থে, শর্ত আছে। ‘সবাই রাজা’, এই স্বত্ব স্বীকারের পথেই তাঁরা রাজার সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। রাজারও কিছু কাজ আছে, যার কর্তা রাজা স্বয়ং। ‘রাজা সবারে দেন মান’ বলেই না সে মান ‘আপনি ফিরে পান’। কাউকে কোনও অসত্যে খর্ব না করার দায়িত্বটিও তাঁরই। আমরা শুধু আমাদের স্বাধীনতার ফল হিসেবে তাঁর সঙ্গে মিলি। কিন্তু তিনি স্পষ্টতই আমাদের চেয়ে বড় কেউ, যদিও তাঁর সঙ্গে ‘সবাই রাজা’ হওয়ার শর্তেই আমাদের মিলন।

এই মিলনের অর্থ রাজাতেই ‘আমাদের’ লীন হয়ে যাওয়া, ভক্তিতে ভক্ত যেমন আরাধ্য দেবসত্তার অংশবিশেষ হতে চান। আমাদের স্বাধীনতার রাজাই যেন জার্মানরা যাকে বলেন ‘গ্রুন্দ’ বা যুক্তির উৎসভূমি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক চিন্তা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দার্শনিকদের চিন্তা থেকে সরে এসে তাঁর নিজস্ব গহিন পথে এগোয়। এই প্রসঙ্গটি বিশদ আলোচনার অপেক্ষা রাখে, কারণ ‘রাজা’র কল্পনা রবীন্দ্রনাথকে সারা জীবন ভাবিয়েছে। ‘আমার রাজার বাড়ি কোথায়’ থেকে ‘ডাকঘর’-এর অমলের রাজা, ‘রাজা’ বা ‘অরূপরতন’-এর রাজা তো আছেনই। রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় ‘রাজা’ চরিত্রের উপস্থিতি নিয়ে আরও অনেক ভাবার আছে। হব্স বা লক বা কান্ট-এর ঈশ্বর মানুষকে বিচারবুদ্ধি দিয়ে নিজে সরে থাকেন। এই গানে রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মানুষের স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি এমন এক ঈশ্বর-কল্পনায়, যিনি মানুষের হককে সম্মান করেন এবং মানুষের যুক্তিবিচারে ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ও বাস্তবায়নে যাঁর নিজস্ব বিধানেরই প্রকাশ। ‘রাজা’ নাটকের গল্পটি আহরিত হয়েছিল একটি বৌদ্ধ জাতকের গল্প থেকে। কিন্তু মনে হয়, এই অবধিই। আজকাল পাশ্চাত্যের পড়াশুনোয় পলিটিকাল থিয়োলজি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এক কথায় বললে, রবীন্দ্রনাথের এই বহুশ্রুত গানটিতে দাসত্বের সমালোচনা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও থিয়োলজিকাল (ঈশ্বরতাত্ত্বিক)। কিন্তু সেই থিয়োলজি তাঁরই নিজস্ব একটি ভাবধারা, যা আরও গবেষণার ও আলোচনার অপেক্ষা রাখে।

শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kingship Rabindranath Tagore slavery Song
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE