Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
রাহুল রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলছেন, কিন্তু মোদীজি?

স্বধর্মে স্থির থাকুন, রাহুলজি

হার্দিক পটেলকে ভোটের আগে ম্যানেজ করার চেষ্টা কম হয়নি। বিজেপি সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে। অল্পেশ আর জিগ্নেশকে নিয়ে হার্দিক যে ত্রয়ী নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে, তার সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া ও আমজনতার মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া দেখে বিজেপি যথেষ্ট ভীত।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১৬
Share: Save:

সাতচল্লিশ বছরের রাহুল গাঁধীর ওপর বেজায় রুষ্ট আমাদের সাতষট্টি বছরের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ কেমন কথা? গুজরাতের সাজানো বাগান ধ্বংস করতে উদ্যত গাঁধী পরিবারের নবীন প্রতিনিধি। শঙ্কা থেকেও মানুষের রাগের জন্ম হয়। প্রধানমন্ত্রী তো বড় ব্যাপার, বিজেপির ছোট মাঝারি নেতারাও এত দিন কেউ রাহুল গাঁধীর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন না। রাহুল মানে ছিল ‘পাপ্পু’, রাজনীতি পাঠশালায় যে অর্বাচীন। ওকে অবজ্ঞা করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। গুজরাত নির্বাচনের মুখে রাহুলের দলের সক্রিয় সভাপতি হয়ে ওঠা, মোদীর রাজনৈতিক ফ্যাশন নকল না করে নিজস্ব স্টাইলে সংযত সচেতন, সহজ–স্বাভাবিক ভঙ্গিতে এগোনো দেখে এত অশান্ত হয়ে উঠলেন কেন খোদ নরেন্দ্র মোদী?

হার্দিক পটেলকে ভোটের আগে ম্যানেজ করার চেষ্টা কম হয়নি। বিজেপি সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে। অল্পেশ আর জিগ্নেশকে নিয়ে হার্দিক যে ত্রয়ী নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে, তার সঙ্গে কংগ্রেসের বোঝাপড়া ও আমজনতার মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া দেখে বিজেপি যথেষ্ট ভীত। তা না হলে দিল্লির রাজ্যপাট ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী গুজরাতে শুধু বিধানসভা নির্বাচনের জন্য যে সময় দিচ্ছেন তা-ও তো অভূতপূর্ব। নির্বাচনে হার-জিত থাকেই। নরসিংহ রাও যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তিনিও তাঁর নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে জেতাতে পারেননি। আর এক তেলুগু বিড্ডা এন টি রাম রাওয়ের হাতে তিনি পরাস্ত হন। কিন্তু এত বছর পর রাও সাহেবের সব ব্যর্থতার গ্লানির পাশাপাশি বলতেই হবে, নব্বইয়ের দশকের আর্থিক সংস্কারের সাফল্য মুছে দেওয়া যাবে না কোনও দিন।

মোদী ভোটে হারতে প্রস্তুত নন। আর তাই এখন গুজরাতের মানুষের কাছে মোদী তাঁর উন্নয়নের সাবেক তাসটি ভুলে গিয়ে সরাসরি সাম্প্রদায়িক প্রচারে নেমে পড়েছেন। রাহুল গাঁধীকে বলা হচ্ছে বাবরের আত্মীয়। মোদী নিজে তাঁকে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করছেন। ভোটপ্রচারের আদিতেই রাহুল প্রশ্ন তোলেন ‘বিকাশ’। বিকাশ কোথায়? গুজরাতে বিকাশ হারিয়ে গিয়েছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ মোদী গোধরার পর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ মহাযজ্ঞের মাধ্যমেই তার ভাবমূর্তির মেকওভার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমরা বলতাম গুজরাত মডেল।

আর এখন?

এখন রাহুল গাঁধীকেই সরাসরি আক্রমণ। ‘পাকিস্তানের চর’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। রাহুল হিন্দু না অহিন্দু, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। এ বার সোমনাথ মন্দিরে গিয়ে রাহুলের শিবপুজো এবং একের পর এক প্রায় ৪০টি মন্দির তিনি সফর করেছেন। রাহুলের এই মন্দির অভিযানের রণকৌশল নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে। কিন্তু তা বলে রাহুলকে ভোটপ্রচারের সময় তাকে ‘অহিন্দু’ আখ্যা দেওয়াও এই ভোটপ্রচারে দেখতে হল! হিন্দু ধর্মে গোঁড়া মুসলমানদের মতো কাউকেই ‘অ-হিন্দু’ ঘোষণা করা হয় না। কোনও হিন্দু গায়ত্রীমন্ত্র পাঠ করেনি বা নিয়মিত জপ-ধ্যান করেনি বলে তাকে হিন্দুধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে এমন কথা জন্মেও শুনিনি। ইসলামের দর্শন উদার, তবু কিছু গোঁড়া মৌলবি এক জন মুসলমান তার ধর্মাচার নিয়মিত না করলে তাকে বিধর্মী ঘোষণা করেন। ইসলামে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘টাকফিরিজম’। এই আরবি শব্দটির অর্থ, এক জন মুসলিম ইসলাম না মানার জন্য যখন অন্য এক জন মুসলিমকে কাফির ঘোষণা করতে পারেন। সুফি ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু হিন্দুধর্মে ২০১৭ সালে বিজেপির কাছ থেকে এহেন রক্ষণশীল ফরমান শুনে মনে হয় এই সংঘ পরিবারই এই দেশটাকে হিন্দু পাকিস্তান গড়ে তুলতে চাইছে।

রাজীব যখন মারা যান তখন টেলিভিশনের পরদায় তাঁর দীর্ঘ অন্ত্যেষ্টি প্রক্রিয়া আমরা সবাই দেখেছি। দুধসাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে রাহুল বাবার মরদেহে পবিত্র ঘৃত মাখিয়ে চন্দন কাঠ হাতে নিয়ে বাবার মুখাগ্নি করলেন। পাশে সাদা শাড়িতে মা সনিয়া। সনিয়া সেই কোন ছোটবেলায় গাঁধী পরিবারের বউ হয়ে চলে আসেন। শাশুড়ির সঙ্গে থেকে হিন্দু আচার অনুষ্ঠান কাছ থেকে শুধু দেখেছেন এমন নয়, অনুসরণও করেছেন। ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও বিবাহসূত্রে ভারতীয় তো বটেই, এমনকী নিজে পুজোআচ্চাও করেন। সব সময়ই তো দেখি ওঁর হাতে বাঁধা মন্দিরের লাল সুতো।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ইয়ান জ্যাক রাজীবের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল রাজীবের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে। রাজীব তাঁকে বলেন, তিনি গোঁড়া কুসংস্কারের দাস নন। কিন্তু আচারসর্বস্বতা নয়, ধর্ম তাঁর কাছে এক অখণ্ড আধ্যাত্মিকতা। যেখানে সমন্বয় আছে, সংঘাত নেই। রাজীব গল্পচ্ছলে বলেন, ঠাকুরদা ছিলেন পারসি। নেহরু নিজে হিন্দু ছিলেন কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ এক ব্যক্তি। আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছিলাম, হোয়টসঅ্যাপে বিজেপির প্রচার, রাহুলের কার্টুন। খালি গায়ে রাহুল পুজোয় উপবিষ্ট। মাথায় মুসলমানের মতো সাদা টুপি। গলায় ঝুলছে ক্রশ আর পৈতে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, রাহুল গাঁধী কী? আপনি আগে ঠিক করুন আপনি কী? আমি এই কার্টুন ও বিজেপির তোলা প্রশ্ন দেখে আরও বিস্মিত হলাম। এটাই তো মানুষের ধর্মীয় সমন্বয়ের ভাবনা।

রাহুল গাঁধী যদি ব্যক্তিগত ভাবে শিবভক্ত হন, পৈতেধারী ব্রাহ্মণ হন তাতে সমস্যাটা কোথায়? মন্দিরে তিনি যদি যান তবে তাতেই বা মহাভারত অশুদ্ধ হয় কী করে? রাহুলের মন্দির যাত্রা দেখেই নাক সিটকোচ্ছেন যে সব বামপন্থী, তাঁদের উদ্দেশেও বলব, অযোধ্যায় রাজীব গাঁধীর শিলান্যাসের সঙ্গে রাহুলের মন্দির অভিযানের কোনও তুলনাই হয় না। ভোটের সময় ভারতের মতো দেশে চিরকালই নেতানেত্রীরা মন্দির-মসজিদে যান। পুজোআচ্চা মানেই প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব— এহেন কট্টর মানসিকতাও ভারতীয় গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের পক্ষে অন্তরায়। আমেরিকাতেও কালো মানুষের অধিকারকে অতিরিক্ত অগ্রাধিকার দিয়েছিল ওবামার দল। জাতীয় নিরাপত্তা, নাগরিক সুরক্ষা, অভিবাসন-অনুপ্রবেশ, এমনকী জাতীয়তাবাদ উপেক্ষিত হয়। ট্রাম্পের রাজনীতির উত্থানে তার অবদান আছে বইকি। যাকে আমি বলি, মার্কিনি সংঘ পরিবারের রাজনীতি। আমাদের দেশেও ধর্মবিরোধী মানসিকতাই রাজনীতিতে বিজেপিকে বাড়তে সাহায্য করেছে।

গুজরাতে ভোটের ফলাফল কী হবে আমি জানি না। ভোটে জয় রাজনীতির ক্ষুদ্র লক্ষ্য, কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, মোদীর ‘অচ্ছে দিন’ নামক কল্পনা, কল্পনাই। বাস্তব নয়। কেউ এক জন সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, অচ্ছে দিন? ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি।’ প্রদীপের নীচে কত গভীর অন্ধকার, এখন গুজরাতের মানুষও তা ধরে ফেলেছেন।

রাহুল উদয়ে ভয়ানক চটে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই মেরুকরণের উগ্র প্রচারে গুজরাতের ভোটব্যাংকে সাম্প্রদায়িক ঝড় তুলে বাজিমাত করতে চাইছেন। এ বার ভাল ফল পেলে বলবেন, রাহুল গাঁধীর নেতৃত্ব ব্যর্থ। গুজরাতিরা বদল চান না। হিন্দুত্বই চান। কিন্তু আমি বলব, সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন প্রচারে রাজধর্মের নৈতিক অধিকার খুইয়েছে বিজেপি। রাহুল সভাপতি হয়ে স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলছেন। কিন্তু মোদীজির আচরণ প্রধানমন্ত্রীসুলভ নয়। বহুত্ববাদ লজ্জায় মুখ ঢাকছে। মোদীজি, আপনি গুজরাতি, লালুজি বিহারি, মমতা বাঙালি, স্ট্যালিন তামিল। কিন্তু রাহুল গাঁধী কী? তিনি কি কাশ্মীরি? তিনি পারসি? তিনি ইলাহাবাদি? আসলে রাহুল যথার্থ ভারতীয়। নানান সত্তার সমাবেশ তাঁর মধ্যে। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, রাহুলজি আপনি কংগ্রেসের এই সনাতন মতাদর্শ থেকে সরে এই ‘উত্তর-সত্য’ যুগের অ্যাম্বাসাডর না-ই বা হলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE