Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
শাসক ও সাংবাদিক মহলের কথোপকথন আজ শূন্যে ঠেকেছে

এই দূরত্ব গণতন্ত্রে চলে না

যে কোনও সাংবাদিকের জীবনে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় আজও যে সতীর্থ সাংবাদিকরা কাজ করছেন, তাঁরাও একই ভাবে বিবিধ রাজনৈতিক চাপের মধ্যেই কাজ করে চলেছেন।

প্রতিবাদমুখর: বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নিধনের প্রতিবাদে সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা জড়ো হয়েছেন, আমদাবাদ, ৬ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

প্রতিবাদমুখর: বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নিধনের প্রতিবাদে সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা জড়ো হয়েছেন, আমদাবাদ, ৬ সেপ্টেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

পঁচাশি সালের কথা। হাওড়ার জগাছায় একটি প্রাথমিক স্কুলে সিপিএমের তৎকালীন এক স্থানীয় নেতা সুবিনয় ঘোষের সঙ্গে প্রধান শিক্ষিকার প্রবল বিবাদ শুরু হয়। সিপিএমের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে সেই প্রধান শিক্ষিকা বিদ্রোহ করেন। হাওড়া জেলার সাংবাদিক হিসেবে নিয়মিত সেই খবর লিখছিলাম। এখন যেখানে নবান্ন, তার পিছনে মন্দিরতলায় ছিল আমাদের বাড়ি। রাতে বাড়ি ফিরতাম শিবপুর ট্রাম ডিপো থেকে। ফেরার সময় মায়াপুরী সিনেমার পিছনের নির্জন গলিতে একদল রাগী সিপিএম কর্মী আমাকে ঘেরাও করে পিস্তল দেখায়। হুমকি দেয়, সুবিনয়বাবুর বিরুদ্ধে আর একটি কথাও লেখা যাবে না। নবীন সাংবাদিক হিসেবে সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথমে রাজনৈতিক থ্রেট। পরদিন শিবপুর বাজারের কাছে জেলা পার্টি অফিসে সম্পাদক প্রয়াত নরেশ দাশগুপ্তকে ঘটনাটি জানালে তিনি তীব্র নিন্দা করেন। বলেন, এ সব কাজে দলের কোনও সমর্থন নেই। পুলিশ সুপার তখন প্রসূন মুখোপাধ্যায়। তিনি একটি এফআইআর করে রাখেন থানায়। আর বলেছিলেন, এফআইআর-টা করে রাখুন যাতে আমাদেরও পরে কোনও ঝঞ্ঝাট না হয়।

যে কোনও সাংবাদিকের জীবনে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় আজও যে সতীর্থ সাংবাদিকরা কাজ করছেন, তাঁরাও একই ভাবে বিবিধ রাজনৈতিক চাপের মধ্যেই কাজ করে চলেছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর সাংবাদিকরাই এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই লড়াইয়ের এক হৃদয়বিদারক পরিণতি গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকাণ্ড! দুর্ভাগ্য, এ নিয়েও রাজনৈতিক তরজা চলছে। বিজেপি বলছে, রাজ্য সরকার কেন নিরাপত্তা দিতে পারেনি? কংগ্রেস এবং দেশের নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ মনে করছেন, দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্বের বিরোধিতার জন্যই গৌরীকে চলে যেতে হল।

প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া, মহিলা প্রেস ক্লাব, প্রেস অ্যাসোসিয়েশন যৌথ সভা করে দোষীদের শাস্তি দাবি করল। পরদিন থেকেই বিজেপির কেন্দ্রীয় পার্টি অফিসে দলীয় মুখপাত্ররা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলতে লাগলেন, সভায় কেন সীতারাম ইয়েচুরি-মহম্মদ সেলিমকে আমন্ত্রণ জানানো হল? বিজেপি নেতাদের বলা হল না কেন? ভারতীয় সংস্কৃতিতে জন্ম বা বিবাহে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু মৃত্যুর মতো শোকের ঘটনায় আমরা নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করি না। আর এ তো মৃত্যুও নয়, হত্যা। প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ি জানিয়েছেন, ‘আমরা কাউকেই আমন্ত্রণ জানাইনি। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ যে কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে। যেমন, আমরা সম্বিত পাত্রকেও আসার জন্য অনুরোধ করেছিলাম।’ আমার প্রশ্ন, বিজেপি নেতারা কেন আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণের অপেক্ষা না করে সেদিন মিছিলে-সভায় শামিল হলেন না?

সাংবাদিকরা রাজনৈতিক নেতাদের জনসংযোগ অধিকর্তা নয়। আমরা দল ও নেতাদের ভালকে ভাল বলব, খারাপকে খারাপ বলব। অভিমত সব সময় যুক্তি বা প্রমাণ নয় তবু ভিন্ন মতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। ক’দিন আগেও দেখেছি নেতা ও সাংবাদিকের মতান্তর কখনও ব্যক্তিগত সম্পর্কে ছায়া ফেলেনি। তিরিশ বছর আগে যখন জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী, তখন তীব্র সিপিএম বিরোধিতাও করেছি। আবার দিল্লিতে ভি পি হাউসে রাজ্যসভার সদস্য, প্রয়াত কনক মুখোপাধ্যায়ের ঘরে গিয়ে দিনের পর দিন আড্ডা মারতাম। সরোজবাবুও তখন এখানে একটানা অনেক দিন থাকতেন। এক দিন সরোজদা বললেন, ‘নতুন জামা পরে এসেছ দেখছি!’ বললাম, ‘আমার জন্মদিন।’ তখন সরোজদা বললেন, ‘কনক, জয়ন্তর জন্য পায়েস করো’। সেদিন রাতে পায়েস খেয়ে বাড়ি ফিরলাম।

জিন্না বিতর্কের পর যখন আডবাণীকে সরানোর দাবি উঠেছে, তখন লিখেছিলাম, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যদি অবসর নিতে পারেন, শ্বেত বিপ্লব করে যদি কুরিয়ান অবসর নিতে পারেন, তা হলে আডবাণী পারছেন না কেন? তিনি লেখাটির অনুবাদ আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, রাজ্যের এক বিজেপি নেতা এটা অনুবাদ করে পাঠিয়েছে। আমি বলেছিলাম, ‘এটা আমার অভিমত। এতে তথ্য বিকৃতি নেই। আপনার প্রতি অশ্রদ্ধাও নেই।’

ঠিক এমন সময় কমলা আডবাণী ঢুকলেন। আডবাণী বললেন, ‘জানো তো কমলা, জয়ন্ত আমার বিরুদ্ধে লিখেছে।’ কমলাজি তখন বললেন, ‘তা হলে আজকে চা খাওয়াব না।’ আডবাণী বললেন, ‘না না, শুধু চা নয়। আজকে মিষ্টি-ও দাও।’ এর পর আডবাণী বলেছিলেন, ‘তুমি ওই রাজ্যের বিজেপি নেতাটির সঙ্গে কথা বলে নিয়ো। হয়তো কোনও কারণে ও তোমার উপর রেগে রয়েছে। তাই আমাকে এ সব পাঠায়।’

এখন পরিস্থিতি বদলের প্রধান কারণ কী?

আমার মনে হয়, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভর সঙ্গে শাসক দলের কোনও কথোপকথন না থাকাই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নরসিংহ রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ— সকলেই দেশে বিদেশে সাংবাদিক বৈঠক করতেন। গত তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী একটি সাংবাদিক বৈঠকও করেননি। তবে কি অতীতের সব প্রধানমন্ত্রী ভুল করেছেন? এখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সংযোগ ও সমন্বয় হল একমুখী। উভমুখী নয়। ট্যুইট, সোশ্যাল মিডিয়া, মন কি বাত এবং সরকারি বিজ্ঞাপন। ইউনেস্কো ডেভিড বিথাম ও কেভিন বয়েল, এই দুই অধ্যাপককে বিশেষ ভাবে নিয়োজিত করেছিল, গোটা পৃথিবীতে গণতন্ত্র নিয়ে ওঠা প্রশ্ন থেকে আশিটা প্রশ্ন বাছাই করতে। এই দু’জন তার উত্তর দেবেন। এই প্রকল্পের ফলস্বরূপ জন্ম নেয় এক অসাধারণ গ্রন্থ। বইটির নাম ‘গণতন্ত্র’। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বিথাম এবং এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বয়েল বলেছিলেন, গণতন্ত্রকে সফল করতে গেলে প্রচার মাধ্যমকে সমাজে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। তাকে স্বাধীন হতে হবে। অর্থাৎ সরকারি বা ক্ষমতাশালী স্বার্থগোষ্ঠীর চাপ থেকে মুক্ত হতে হবে।

শুনলাম, কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রপতি ভবনে সুইৎজারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির সম্মানে নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী মোদী সাংবাদিকদের সামনে মন্তব্য করেছেন, ‘আজ আমাদের দেশের সবথেকে বড় ট্র্যাজেডি সংবাদমাধ্যম। আমরা এত ভাল কাজ করছি। তবু তারা ভালটা দেখতে পায় না।’

রাজা অয়দিপাউস একবার বলেছিলেন, আমি রাজা। মানুষের কল্যাণ চাই। আমি জানি, মানুষের কল্যাণ কীসে হবে। সেটাই রাজধর্ম।’ তখন তাঁর পুত্র বলেছিলেন, ‘রাজা তো প্রজাকে নিয়ে। প্রজা কী চাইছে, কী ভাবছে, সেটা জানা কি রাজার জন্য জরুরি নয়?’ গ্রিক নাটকের সেই প্রশ্নটি আজ প্রধানমন্ত্রীকে করতে ইচ্ছে করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE