নিশানা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে বিক্ষোভ। কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১৬
সংসদ ভবনে প্রথম প্রবেশের আগে নরেন্দ্র মোদী সিঁড়িতে প্রায় শুয়ে পড়েছিলেন। দুনিয়ার ক্যামেরা সে ছবি লুফে নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে মহানায়ক গণতন্ত্রের সদর দফতরে সাষ্টাঙ্গে না হলেও নিদেনপক্ষে পাঁচ-ছ’টা অঙ্গে প্রণাম করছেন— সে দিন বিশ্বে সে কী কলরব!
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি। গত আড়াই বছরে সংসদে মাঝেমধ্যে মহানায়কের পদধূলি পড়েছে। তিনি তর্ক করতে ভালবাসেন না, ভাষণ দিতে ভালবাসেন, নিজের মর্জি এবং হিসেব মাফিক ভাষণ দেন, কখনও বেতারে, কখনও জনসভায়, কখনও সম্মেলনে, কালেভদ্রে সংসদের সভাকক্ষেও। কিন্তু ভিন্নমত শোনা, নিজের মত অন্যকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নেওয়া, নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার অন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া, এ সব তাঁর ধাতে নেই। অবশ্য মোদীজি হয়তো বলবেন, পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার সরল সমাধান তাঁর জানা আছে, অন্যের মতামত শোনার দরকার কী? আর, সত্যিই, গণতন্ত্র-প্রবীণ ভারতের ভোটদাতারা তো ২০১৪ সালে এই ভাবমূর্তিটিকেই শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে বরণ করেছেন। ‘তোমরা আমাকে ক্ষমতা দাও, আমি তোমাদের হাতে চাঁদ এনে দেব’, মোটামুটি এমন একটা স্লোগান দিয়েই তো নরেন্দ্র মোদীর রাজদরবারে আগমন। সুতরাং, হে প্রাজ্ঞ ভারতবাসী, গণতন্ত্র অনেক দেখেছেন, এখন কব্জি ডুবিয়ে মহানায়কতন্ত্রের স্বাদ নিন।
শ্রীযুক্ত উর্জিত পটেলও মনে হয় সেই স্বাদে মজে আছেন। নোট বাতিলের মতো সাংঘাতিক সিদ্ধান্তের পরেও তাঁকে সাদা চোখে বিশেষ দেখা যায়নি। ক্বচিৎ কদাচিৎ দর্শকদের ভাগ্যাকাশে তাঁর উদয় হয় বটে, কিন্তু ওইটুকুই— গভর্নর সাহেবকে অবলোকন করে বলতে সাধ হয়: দেখা দেয় কথা কয় না। আর, যদি বা দু’চার ছত্র বলেন, শুনলে মনে হয় জিহ্বাগ্রে প্রধানমন্ত্রী অধিষ্ঠান করছেন। বলার ভঙ্গিটা অবশ্য বেশ ছিমছাম, ও-সব সস্তা থিয়েটারি ঢং-টং নেই, কিন্তু কথাগুলো একেবারে মোদীভাষ্যের কার্বন কপি! রঘুরাম রাজন না হয় বরাতজোরে এক বারই পাওয়া যায়, তাই বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এত সহজে নিজেকে আগমার্কা জো-হুজুর ছাঁচে ঢেলে নিল? দেশের যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে মানুষের একটা গর্ব আছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এত দিন তাদের প্রথম সারিতে ছিল। মোদী-রাজ তাকেও গিলে নিল? নিঃশব্দে?
না, সৌভাগ্যের কথা, একেবারে নিঃশব্দে বলা যাবে না আর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মী ও অফিসারদের একাধিক সংগঠন শেষ পর্যন্ত সরব হয়েছেন। এবং লিখিত ভাবে। তাঁরা উর্জিত পটেলের কাছে অভিযোগ করেছেন যে, নোট বাতিলের ঘটনাপরম্পরায় কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাঁদের আবেদন, গভর্নর যেন নর্থ ব্লকের এই অনধিকার চর্চা আর মেনে না নেন, নিজের প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার রক্ষায় তিনি যেন তৎপর হন। এই অভিযোগের জবাবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক পত্রপাঠ বিবৃতি দিয়েছেন যে, তাঁরা মোটেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার হরণ করেননি, তার সঙ্গে ‘আলাপ আলোচনা’ করেই নোট বাতিল বিষয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ করা হয়েছে। আলাপ-আলোচনা ব্যাপারটা ক্ষমতাবানদের পক্ষে খুবই কাজের জিনিস, হীরকরাজও তাঁর নীতিকথাগুলি সম্পর্কে মন্ত্রীদের প্রত্যেকের মত জানতে চেয়েছিলেন। সবাই বলেছিলেন: ঠিক, ঠিক।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মীদের অভিনন্দন, তাঁরা ‘ঠিক, ঠিক’ বলেননি। না-বলার একটা বড় কারণ, তাঁদের আত্মমর্যাদাবোধ। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় এই বিষয়েই এক প্রবন্ধ লিখেছেন রত্নাকর শেঠ। তাঁর বক্তব্য, নোট বাতিলের হুকুমবাজি এবং ধারাবাহিক অব্যবস্থায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আধিকারিক ও কর্মীদের একটি অংশ অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেছেন ও করছেন। বস্তুত, ‘যে ব্যাঙ্কে কাজ করার গৌরবে তাঁরা গর্বিত... সেই প্রতিষ্ঠানকে চরিত্রভ্রষ্ট হতে দেখে, তার অকল্পনীয় অবনমন দেখে তাঁরা শুধু লজ্জিতই নন, একপ্রকার আত্মপরিচয়ের সংকটে বিভ্রান্ত, বিড়ম্বিত।’ (রিজার্ভ ব্যাঙ্কে অন্তঃক্ষরণ, আরেক রকম, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭) এই তীব্র অনুভূতিই শেষ পর্যন্ত তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের কাছে অভিযোগ এবং আবেদন জানানোর প্রণোদনা দিয়েছে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিক্রিয়া। একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার যাঁরা, তাঁরা ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করলেই যে সেই প্রতিষ্ঠানের কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায় না, তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক পরিসর ষোলো আনা হারিয়ে যায় না, বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা যে নৈতিকতার অবস্থান থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেন, সরব হতে পারেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিবাদীরা সেটা নির্ভুল ভাবে দেখিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মানেই তার গভর্নর নয়। বুঝিয়ে দিলেন, যে কোনও প্রতিষ্ঠানেরই সামর্থ্য এবং মর্যাদা নির্ভর করে, কেবল তার মালিক বা পরিচালক নয়, তার কর্মীদের ওপরেও। আমরা অনেক সময় কথাটা মনে রাখি না, কর্মীরা মন দিয়ে কাজ করছেন কি না, শুধু তার হিসেব কষি। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের সম্মান রক্ষায় সক্রিয় হচ্ছেন কি না, প্রয়োজনে পরিচালকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন কি না, সেটাও খুব বড় প্রশ্ন। এখানেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের সম্ভাবনা।
আপাতত সম্ভাবনাই, তার বেশি কিছু নয়। বাজারে অতিকায় পুঁজির দাপট, রাষ্ট্রে অতিনায়কের— সরকারি বা বেসরকারি কোনও পরিসরেই কর্তারা বহুজনের মতামতের তোয়াক্কা করবেন না, সেটা অস্বাভাবিক নয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের পরিসর অত্যন্ত সীমিত এবং সেই সীমিত পরিসরেও বিবাদী স্বরকে দমন করার প্রকরণগুলি সর্বদা সজাগ, সক্রিয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কও হয়তো শেষ অবধি তার ব্যতিক্রম নয়। উদ্ধৃত প্রবন্ধের উপসংহারেও পড়ি, ‘এমন এক অন্ধকার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কর্মরত আধিকারিক-কর্মীরাও যেন দরিদ্র, নিঃস্বদের মতো অসহায়। মর্যাদা লুপ্ত, প্রতিষ্ঠানও লুপ্তপ্রায়। হয়তো এই ক্ষরণের মধ্য দিয়েই ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিসমাপ্তি।’
হয়তো বা। ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য কথা বলার সামর্থ্য ও সুযোগ ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। কিন্তু তবু, ‘পরিসমাপ্তি’ ঘোষণায় সায় দিতে পারব না। বলব, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর বন্দনাগীতিই শেষ কথা নয়, তার পরেও টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের লেজে— না, ‘ভরসা থাকুক’ বলব না, বলব— ভরসাটা তৈরি করে নিতে হবে। সর্বত্র, প্রতিনিয়ত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ভরসা আসলে সৎসাহসের। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আধিকারিক ও কর্মীরা যে সৎসাহস দেখাতে পেরেছেন। নিশ্চয়ই তাঁদের কিছু সুবিধে আছে, বড় মাপের সংগঠন আছে, সংগঠিত সক্রিয়তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, কাজের নিরাপত্তা আছে অনেকখানি। সেই শক্ত ভিতটা না থাকলে প্রতিবাদের সাহস জোগাড় করা কঠিন কাজ। কিন্তু সে কাজ সহজ হবেই বা কেন? গণতন্ত্র চড়ুইভাতি নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy