একটি স্কুলের গেট শুদ্ধীকরণের কাজ চলছে নয়াদিল্লিতে। পিটিআই
অনেকতত্ত্ব, অনেক বিশ্বাস, অনেক ধারণা আজ করোনার দাপটে ভেঙে গিয়েছে। পৃথিবীর ১৮০টির উপর চার লক্ষের উপর বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ, কত সহস্র জাত, উপজাত, বর্ণ লক্ষাধিক ভাষা বলা মানুষ আজ এক হয়েছেন। এক শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। হ্যাঁ অবশ্য এই শয়তান আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। পৃথিবীর অনেক শিশুর, পরিজনদের অনাথ করে দিচ্ছে। তবুও কিছু শিক্ষা আমাদের দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অনেক মানুষ পঙ্গু ও অঙ্গবিহীন হয়ে পড়েছিলেন তবু আমাদের চেতনা তথা আত্মার মানের কোনও উন্নয়ন ঘটেনি। দেশ-দশের লড়াই, ধর্মীয় লড়াই, জাতিগত, বর্ণগত, ভাষাগত লড়াই এখনও চলছে। হিংসা, ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কার, ক্ষমাহীনতা, অস্থিরতা, ইন্দ্রিয়ভোগ্য বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত চাহিদা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারা, মানসিক অস্থিরতা, দেশ ও দশের প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাওয়া, স্বার্থপরতা, আইনের প্রতি অবহেলা আমাদের সমাজ ও সভ্যতা ভেঙে চুরমার করে চলেছে। আমরা ভুলে গিয়েছি পৃথিবীর অনেক সভ্যতা যাথা মায়া, সুমেরীয়, মেসোপটেমিয়া তথা সিন্ধু সভ্যতা দীর্ঘদিন টিকে থাকলেই হারিয়ে গিয়েছে। এরই ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়া, তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব আরও অনেক সভ্যতাই যে হারিয়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্ব ও ভারতের ঐতিহাসিকপূর্ণ (ইতিহাস যখন থেকে জানা যায় প্রামাণিক হিসাবে) সময়ের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কখনও বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক হতে পারে। কখনও ধর্মীয়, কখনও রাজনৈতিক, কখনও অর্থনৈতিক কারণে এই লড়াই আসছে এবং এখনও চলছে। আমরা ভুলে যাই ৪৫০ কোটি বছর পূর্বে যে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল তার সবচেয়ে উন্নততর, বুদ্ধিমান প্রজাতি ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে এই পৃথিবীতে স্থান নিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের স্কেলিটাল পরীক্ষা করে প্রাচীনতম আধুনিক কঙ্কালের বয়স ৩ লক্ষ (আফ্রিকার ইথিওপিয়া) বছর। মানুষের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে যখন মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হল যখন থেকে মানুষ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্যের উপর অথবা কম বিনা পরিশ্রমে চাহিদারিক্ত জিনিসের উপর তার দাবি বসাতে শুরু করল।
দেশ ভাগ হল, ধর্মীয় বিভেদ হল, জাতিগত বিভেদ হল আর মানুষ তার স্বাভাবিক গুণগুলি হারিয়ে পাশবিক গুণের উপরে জোর দিল। যে প্রকৃতি তাকে সৃষ্টি করেছে, যার দেওয়া বাতাস, জল, আলো, মাটি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য আঘাতের পর আঘাত করতে লাগল। প্রকৃতি উপর এই আঘাত অনেক দিন সহ্য করার পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। তাই দিল্লি দূষণে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকেই শহর ছেড়ে অন্যত্র বাসস্থানের খোঁজ করছে। আর মাত্র এক-দুই শতাংশ মানুষ যাঁদের হাতে অর্থ, ক্ষমতা আছে তারা যথেচ্ছ হারে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন করে চলেছে। তার ফল বাকি ৯০ শতাংশ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। আর ১৫-২০ শতাংশ মানুষ কোনওরকমে জীবনধারণ করে চলেছে।
আমরা মন্দির, মসজিদ, গির্জা নিয়ে যতটা অর্থনৈতিক ব্যয়-বরাদ্দ করি সে অর্থের কিছু মাত্র অংশ হাসপাতাল, বিদ্যালয় তৈরি অথবা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য ব্যবহার করা হত, যদি তাঁদের মূল্যবান সময়ের কিচুটা সময় সমস্ত মানুষকে একটা সম্মানজনক অবস্থায় তুলে আনার চেষ্টা করা হত, তবে আজ এই মহামারি হাহাকার দেখতে হত না।
আজকে এই বিপদের সময় এক হয়ে যে শিক্ষা নিচ্ছি তাকে বজায় রাখতে হবে। এক দিনে পরিবেশের দূষণ কমেছে, আকাশের দৃশ্যমানতা বেড়েছে, মানুষ বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে, লুকিয়ে থাকা সামুদ্রিক প্রাণীগুলি দেখতে পাচ্ছি।
দেশ তার সীমানা বিভেদ ভুলেছে, ধর্মীয় রক্ষকেরা উপলব্ধি করেছে মানুষ আগে। ধর্ম পরে। ভাষা-জাত-লিঙ্গ-বর্ম বৈষম্য ভুলে আমরা এক হয়ে এই মারণ ভাইরাসকে প্রতিহত করতে বুক বেঁধে নেমেছি। ধর্ম নয়, নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানই শেষ সম্বল ধর্মরক্ষকেরা তা বুঝে গিয়েছেন। জ্যোতির্শাস্ত্রকারেরা দূরে হঠেছেন, কোনও ভবিষ্যৎবাণী করার সাহস পাচ্ছেন না বা মানুষও এই ধর্মস্থান তথা জ্যোতিষে ভরসা পাচ্ছেন না। চাতকপাখির মতো হাঁ করে আছেন কখন বিশ্বের এতগুলি দেশের অহোরাত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা টীকা আবিষ্কার করে মানবজাতি এই ভয়ঙ্কর দস্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ প্রশাসন অতন্দ্র প্রহরীর মতো মানুষকে রক্ষা করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করে চলেছেন।
যে মানুষ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাত, যে অপরাধীর চুরি-ডাকাতি-হত্যা-ধর্ষণে ব্যস্ত থাকত তাদের চেতনার স্তরের পরিবর্তন হতে চলেছে। রাজনৈতিক নেতারা দলাদলি বন্ধ করে এক হয়ে দেশের কথা ভাবছেন দল বা পার্টির কথা ভুলে। হ্যাঁ-এটাই মানবিক ধর্ম, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আর প্রকৃতিরও সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ।
করোনার টীকা আমরা আবিষ্কার করবই আর এই মহামারির হাত থেকে সমাজ ও সভ্যতাকে রক্ষা করবই এই হোক আমাদের একমাত্র আওয়াজ। কিছু স্বার্থপরের মতো প্রকৃতিকে নষ্ট করা, পরিবেশকে দূষণে ভরিয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত মুনাফার জন্য মানুষের প্রতি শোষণ, ধর্ম-বর্ণ-জাত-দেশ-মাটি ভুলে আমাদের একটাই পরিচয় হোক। আমরা মানুষ। ধর্মীয় ভাবাবেগ থাক কিন্তু তা যেন বিজ্ঞানকে আঘাত না করে। কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, অপ্রয়োজনীয় স্বার্থে অর্থ অপচয়ে আমাদের সভ্যতার অগ্রগতিকে পিছিয়ে দেবে। আর সত্যর প্রতি নিষ্ঠা, সমাজ ও সভ্যতার প্রতি নৈতিক দায়িত্ব সুস্থ্য সংস্কৃতি সম্পন্ন মানুষই পারবে যে কোনও বাধা দূর করতে। যুদ্ধ চাই না, অস্ত্র চাই না বিজ্ঞান মানবসভ্যতার কল্যাণে ব্যবহার হোক। সবার দেশ আমার দেশ।
লেখক চিকিৎসক এবং পুরুলিয়া বিজ্ঞানমঞ্চের সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy