Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
দু’মাসে বারোশো কোটি টাকা ব্যয়, ছোট চাষি পেলেন কতটুকু?

ধান কেনার নীতি ও রাজনীতি

দেশজোড়া কৃষক বিক্ষোভে থরহরি কেন্দ্রীয় সরকার ধানের দর বেঁধেছে কুইন্টালে ১৭৫০ টাকা। প্রতি বছর পঞ্চাশ-একশো টাকা সরকারি দর বাড়ে, এ বার এক লাফে তিনশো টাকা। পেলে হাতে চাঁদ পাবে বাংলার চাষি। কিন্তু পাচ্ছে কই? ‘‘সরকার যত বেশি ধান কিনবে, ফড়ের পকেট তত বেশি ভরবে’’, বললেন এক গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ধা ন কাটা শেষ, আলু তুলছেন চাষি। চোখ ধাঁধাচ্ছে সরষে ফুল, নধর হয়েছে শিম, টম্যাটো, বেগুন। খেজুরগাছে রসের হাঁড়ি। তবু পৌষের শেষে গ্রামে গিয়ে দাঁড়ালে গা শিউরে ওঠে। স্বজনপোষণের পচা পাঁক, ভ্রান্ত নীতির চোরাবালি। কোন পথে লক্ষ্মী যাবে চাষির ঘরে?

দেশজোড়া কৃষক বিক্ষোভে থরহরি কেন্দ্রীয় সরকার ধানের দর বেঁধেছে কুইন্টালে ১৭৫০ টাকা। প্রতি বছর পঞ্চাশ-একশো টাকা সরকারি দর বাড়ে, এ বার এক লাফে তিনশো টাকা। পেলে হাতে চাঁদ পাবে বাংলার চাষি। কিন্তু পাচ্ছে কই? ‘‘সরকার যত বেশি ধান কিনবে, ফড়ের পকেট তত বেশি ভরবে’’, বললেন এক গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। দল তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁর সাফ কথা, সরকারি কড়াকড়ি লোক দেখানো, সত্তর শতাংশ ধান ফড়েতেই দিচ্ছে। এ হল বর্ধমানের জামালপুরের কথা। তৃণমূলের খাসতালুক। উত্তর চব্বিশ পরগনার আমডাঙা-গাইঘাটায় রাজনৈতিক অশান্তি চরমে। সেখানে চাষিরা নিশ্চিত, সাতানব্বই শতাংশ দিচ্ছে ফড়ে।

এত ঘোষণা, এত প্রচার। তবু এই ছবি কেন? এত দিনে চাষির বঞ্চনার নকশাটা স্পষ্ট। এক, কবে ধান কেনা হবে, খবর পাচ্ছেন না চাষি। অথচ আগাম খবর যাচ্ছে পঞ্চায়েত তথা শাসক দলের ঘনিষ্ঠদের কাছে। দুই, ধর্না দিয়ে চাষি যদি-বা ধান বিক্রির টোকেন পান, তার দিন পড়ছে মাস পেরিয়ে। তিন, শিবিরে গিয়েও ধান নিয়ে ফিরতে হয়েছে, এমন চাষি প্রায় প্রতি পঞ্চায়েতে আছেন। ভ্যান ভাড়া গচ্চা, একটা দিন নষ্ট। তাঁদের দেখে ওমুখো হচ্ছেন না অন্যরা। চার, যদি-বা ধান কিনছে চালকল, কুইন্টালে ছ’সাত কিলোগ্রাম বাদ দিচ্ছে। ছোট চাষিও হারাচ্ছেন ষাট-সত্তর কিলোগ্রাম ধানের দাম। চাষির নালিশ, নিরুৎসাহ করতেই এত বেশি বাদ দিচ্ছেন মালিকরা। কই, ফড়েদের তো এত বাদ পড়ছে না?

এত বাধা পেরিয়ে ধান দিলেও, ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকবে কবে নিশ্চয়তা নেই। এ বছর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘হাতে হাতে চেক’। যেন হাতে হাতে চেক মানেই হাতে হাতে টাকা। গত ছ’বছরে চাষির অভিজ্ঞতা বলছে, চেক জমা দিয়ে বসে থাকতে হয়, কবে অ্যাকাউন্টে ঢুকবে টাকা। এ বছরও ডিসেম্বরে যাঁরা ধান দিয়েছেন, টাকা ঢোকার প্রত্যাশায় দিন কুড়ি-পঁচিশ কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। সরকারি তথ্য, এমন চাষির সংখ্যা অন্তত ষাট হাজার।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ‘ক্ষমতা’ মানে অপেক্ষা করার ক্ষমতা। ধান এক মাস রেখে দেওয়া, অ্যাকাউন্টে টাকা আসার জন্য দু’মাস বসে থাকা, এ যাঁরা পারেন, তাঁরা অন্তত দশ-বারো বিঘের মালিক। যাঁদের সংখ্যা সর্বাধিক, সহায়তার প্রয়োজনও তীব্র, সেই দুই-আড়াই বিঘের চাষিরা ধান তুলেই আলু, আলু তুলেই ধান, এই চাকায় বাঁধা। তাঁরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন মাঝের ব্যবসায়ী শ্রেণিকে। ডিসেম্বর মাসে উত্তর চব্বিশ পরগনায় এই চাষিরা কুইন্টাল ১৩৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন ফড়েকে, বালুরঘােট ১৩৫০, মালদহে ১৩৬০, বীরভূমে ১৩৮০, বর্ধমানে ১৪০০, হাওড়া-হুগলিতে ১৪৩০ টাকা।

অথচ ব্যবসায়ীকে আটকে চাষির থেকে ধান কেনা শুধু যে দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রশ্ন, তা তো নয়। সরকার গত বছর সাড়ে চার লক্ষের মতো চাষির থেকে ধান কিনেছিল, যা মোট (জমির মালিক) চাষির মাত্র দশ শতাংশ। সরকারি ক্রয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য, ধানের বাজারদর বাড়ানো। চাষির ধান যদি ব্যবসায়ী আগেই কিনে রাখে, তা হলে সরকারি দর চড়া হলেও বাজারে দাম বাড়বে না। আর ঠিক তা-ই হয়েছে। কার্তিকের শেষে রাজ্যের যে জেলায় ধানের যে দর ছিল, মকর সংক্রান্তিতে এসেও সেই দর। বড় জোর কুইন্টালে কুড়ি টাকা বেড়েছে।

খাদ্য দফতর বলছে, ২০১৮ সালে পয়লা নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর, এই সময়ে ৬.৯ লক্ষ টন ধান কিনেছে সরকার। ২০১৭ সালে ওই একই সময়ে কিনেছিল ২.২৫ লক্ষ টন। মানে, এ বার তিনগুণেরও বেশি ধান কিনেছে, খরচ গত বছরের চাইতে আটশো কোটি টাকারও বেশি। তা সত্ত্বেও বাজারে ধানের দামে হেরফের হয়নি। তা হলে করদাতার এতগুলো টাকা চাষির কোন কাজে লাগল?

ধন্দ লাগে আরও এই কারণে যে, সরকারের খাতায় কলমে যা দেড় মাস, আসলে তা বড়জোর দিন পনেরো-কুড়ি। ধান উঠতে শুরু করে নভেম্বরের শেষে। এত অল্প সময়ে এত ধান সরে গেল বাজার থেকে, অথচ বাজারে তার বিন্দুমাত্র প্রভাব বোঝা গেল না, এ কী করে সম্ভব!

একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা, চালকল মালিক আর খাদ্য দফতরের কর্মীদের মিলিত দুর্নীতি। চালকল মালিকরাই একান্তে স্বীকার করেন, বহু ধান কেনা হয় কেবল খাতা-কলমে। ধান ‘অডিট’ করার কোনও ব্যবস্থা নেই। সরকার চাল চাইলে বাজার থেকে সস্তার চাল কিনে দিয়ে দেন মিল মালিক। তা-ও সময়মতো দিতে না পারায় বেশ কিছু মিল মালিক ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছেন। অনেকে আবার একই ধান ‘রোল’ করান। কেনা ধান ঘুরপথে ফিরে যায় মান্ডিতে, ফের কেনা হয়ে আসে। কত ধান কেনা হল, সরকারি পরিসংখ্যান দেখে তা বোঝার সাধ্য নেই।

কেবল প্রশ্ন জাগে, এ বছর কি তিনগুণ বেশি চালকল ধান কিনতে নেমেছে? তিন শিফটে ধান কেনা হচ্ছে মান্ডিতে? তিনগুণ বেশি শিবির হচ্ছে গ্রামে? তিনগুণ বেশি ট্রাক ফেরি করছে ধান? গ্রামে ঘুরে তো এমন বাড়তি তৎপরতার আভাস মেলে না। তা হলে কোন জাদুবলে একই সময়ে তিনগুণ বেশি ধান কেনা হল?

প্রশ্ন শুধু দুর্নীতির নয়, সরকারের নীতিরও। প্রতিটি ব্লকে কৃষক মান্ডি যে চাষির কাজে লাগেনি, তা এত দিনে স্পষ্ট। ওই টাকায় তখন ট্রাক কিনে চাষির থেকে সরাসরি ধান কেনার ব্যবস্থা করলে হয়রানি কমত। চাষিকে গ্রাম ছেড়ে মান্ডিতে বা চালকলে যেতে বলা মানেই সে হয়রান হবে, ঠকবে। গ্রামে ধান কেনা হলে ছবিটা উল্টে যায়। ‘‘আমাদের গ্রামের বাচ্চু (ফড়ে) বাইক নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, কেউ ধান দিচ্ছে না’’, বললেন বীরভূমের মহম্মদবাজারের ফতেমা বিবি। ভুতুড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের শেওড়াকুড়ি গ্রামের ‘মিতালী সংঘ’-এর সদস্য তিনি। সংঘ গ্রামের ঘর ঘর থেকে ধান কিনছে।

গ্রামে চাষি সুরক্ষিত, কারণ সেখানে তাঁকে সবাই চেনেন। ‘‘সংঘের মেয়েরাই বলে দেয়, এ চাষি, এর থেকে নাও’’, বললেন ফতেমা। বেনোজল সবটা হয়তো আটকায় না, তবু চাষির ন্যায্য দামে বিক্রির সম্ভাবনা গ্রামেই সর্বাধিক। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার লিখছেন, ‘‘সরকারের উচিত কৃষকদের বাড়ি বাড়ি সরকারি এজেন্ট পাঠিয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনা। ডোরস্টেপ ব্যাঙ্কিংয়ে যেমন হয়।’’ (আবাপ, ২-১)।

হচ্ছে ঠিক উল্টো। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর অবধি যত চাষি ধান বিক্রির জন্য নাম লিখিয়েছেন (১.১ লক্ষ) ২০১৮-তে ওই সময়ে নথিভুক্তি তার সাড়ে তিনগুণ (৩.৬ লক্ষ)। কিন্তু পঁচানব্বই শতাংশেরও বেশি নথিভুক্তি মান্ডিতে। গ্রামে শিবির করে যারা ধান কেনে (স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং সমবায়) তাদের কাছে নথিভুক্ত চাষির অনুপাত এ বছর সামান্য কমেছে, ৪.৬ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ। মানে, ধান কেনা মান্ডিমুখী। যেখানে কে চাষি, কে ফড়ে, বোঝার সাধ্যি নেই। এক-এক জন ফড়ে কয়েক ডজন চাষির নাম লেখাচ্ছে। চাষি চেক পাওয়ার আগেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার কাগজ (উইথড্রয়াল স্লিপ) লিখিয়ে নিচ্ছে নিজের নামে। বর্ধমানে এক দরাজ ফড়ে টোকেনের বিনিময়ে চাষিকে ‘গিফট’ দিচ্ছে প্যান্ট পিস, ইমার্জেন্সি লাইট। তবে অধিকাংশ চাষিই কিছু পাচ্ছেন না।

উপায় কী? স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সাধ্য সামান্য, তাদের নিজস্ব ট্রাক নেই, গুদাম নেই। কৃষি সমবায় জীবন্মৃত, ২০১৩ সাল থেকে নির্বাচন হয়নি। আগে পঞ্চায়েতের উদ্যোগে শিবির হত। এ বার বহু পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনই হয়নি, আরও অনেক গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে অচল। সেখানে ধান কেনার দাবি তুলে ‘বিরোধী’ তকমা পেতে কে চায়? চাষি নীরবে ফুঁসছে।

দু’মাসে বারোশো কোটি টাকার ধান কেনার পরেও যে ধানের বাজার উঠল না, তা কৃষিনীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলে দেয়। রাজ্য সরকার বছরে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করে কৃষিবিমার প্রিমিয়াম দিতে। ক্ষতিপূরণ দিতে গড়ে তিনশো কোটি টাকা। এ বার চাষির মৃত্যু-অনুদানেও বছরে কয়েকশো কোটি টাকা যাবে। এত টাকা শুধু সহায়তায় গেলে, কৃষি উন্নয়নের টাকা আসবে কোথা থেকে?

গত বাজেটে দেখা গিয়েছে, সেচ প্রকল্পে, কৃষি বিপণনে, হিমঘর-গুদামের মতো পরিকাঠামো নির্মাণে রাজ্যে খরচ হয়েছে বরাদ্দের চেয়ে কম। অর্থাৎ চাষকে লাভজনক করতে সরকার যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে না। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিকে বাঁচাতে বাজেট-বহির্ভূত নতুন নতুন প্রকল্প আনছে।

কেন চাষির ঠ্যাং ভেঙে লাঠি ধরানো? হয়তো মনে করিয়ে দিতে, কে হাতে দিচ্ছে চেক। পরিকাঠামো এক বার গড়ে দিলে কে আর মনে রাখে, কে গড়েছিল। কিংবা হয়তো চাষির সুরক্ষার চাইতেও, তার বরাদ্দের উপর নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি। এখন এক-এক মাসে কয়েকশো কোটি টাকার ধান যাচ্ছে চালকলে। আর কে না জানে, চালকল মালিকেরা রাজনৈতিক দলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। চাষি ভয়ে আছেন, ভোট আসছে, কী না জানি হয়। চাষির জীবিকা-রক্ষার টাকা শেষ অবধি তাঁর জীবনসংশয় করে কি না, এই চিন্তায় দিন গুনছে গ্রাম।

অন্য বিষয়গুলি:

Middleman Paddy Farmer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE