Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

ভারতকে তিনি সব দিয়েছিলেন

দুই দশকের অল্প কিছু বাদে, স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বরে, ভারত ডাক দিল মার্গারেটকে। এ দেশে এসে কল্যাণব্রতে দীক্ষা নিয়ে ‘নিবেদিতা’ হলেন মার্গারেট।

অাজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫১তম জন্মদিন

অাজ ভগিনী নিবেদিতার ১৫১তম জন্মদিন

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ঠিক দেড়শো বছর আগে সুদূর আয়ারল্যান্ডে খ্রিস্টের কাছে এসে কেঁদে পড়লেন তরুণী মেরি হ্যামিলটন। তাঁর গর্ভে প্রথম সন্তান। হলই বা বিদেশ, সে কাল ছিল বড় কঠিন। শিশু যে নিরাপদে পৃথিবীতে আসবেই, নিশ্চয়তা নেই। মেরি পণ করে বসলেন, সন্তান যদি নির্বিঘ্নে আসে, তবে তাকে নিবেদন করবেন দেবতার কাজে। প্রস্তাবটা বোধহয় ওই নীলাকাশে কারও ভারী মনে ধরল। তাঁর আশীর্বাদ রূপে একটি সাদা ধপধপে গোলাপ ঈশ্বরের বাগান থেকে খসে নেমে এল মর্তে। শিশুটির নাম হল মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। রত্ন মেয়ে। বয়সের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে তার মেধা। যা দেখে, অদ্ভুত আয়াসে আয়ত্ত করে। যুক্তিবিদ্যায় ঘোর পারদর্শিতা। তার সঙ্গে অধ্যাত্মের জটিল তত্ত্বেও চমৎকারের রস খুঁজে নেয়। পশ্চিমে তার পাপড়ি মেলার দিনগুলিতে পূর্ব দিকের ভারত দেশে গঙ্গা নদীর পাড়ে বইছে অলৌকিক। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, চর্মচক্ষে ভগবানকে দেখেছেন। অনুভব করেছেন, যিনি আল্লা তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই কালী তিনিই খ্রিস্ট।

দুই দশকের অল্প কিছু বাদে, স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বরে, ভারত ডাক দিল মার্গারেটকে। এ দেশে এসে কল্যাণব্রতে দীক্ষা নিয়ে ‘নিবেদিতা’ হলেন মার্গারেট। দিব্যশক্তিতে নিজের মধ্যে স্থান দিলেন এই দেশ, এই ধর্ম, তার সংস্কৃতি, ভাল-মন্দকে, এবং তার আত্মাকে। এই যে এক জীবনে এক মত থেকে অন্য মতে যাওয়া, বিদেশিনির খোলস ছেড়ে ভারতমানবের লোকমাতৃকা হয়ে ওঠা— এই বিস্ময়কাণ্ডকে একই দেহে জন্মান্তর বলব না?

ভারতকে নিবেদিতা কতখানি আপনার করে নিতে পেরেছিলেন, তারই এক গনগনে উদাহরণ সিস্টারের কালীপ্রেম। শ্যামা মায়ের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে এই শ্বেতাঙ্গিনী। তাঁর কালীচেতনা হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের পথে চলেই অবয়ব পেয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে মিশে আছে নিবেদিতার নিজস্বতা। নিবেদিতা ও কালীর আত্মজ-সম্পর্কের সেই তাজ্জব কাহিনির খণ্ড-বিখণ্ড রাখা আছে নিবেদিতার বক্তৃতার কপিগুলিতে, তাঁর লেখা একটি চটি বই আর অগণন চিঠিতে। মা কালীতেই যেন ঘনীভূত ছিল তাঁর সব কাজের প্রাণশক্তি, মা কালীই গড়েছেন তাঁর শিক্ষা, সেবা, উৎসর্গ করার ক্ষমতা ও খাপ-খোলা তলোয়ারের মতো ব্যক্তিত্ব।

নিবেদিতা হয়তো পাশ্চাত্যের প্রায়শ্চিত্ত। যে পশ্চিম বারে বারে দূত পাঠিয়েছে, যে দূত মনে করেছে ভারতের সবটা কেবল অন্ধকার আর কুসংস্কারে ঠাসা, তাকে নিজ ধর্মে স্নান করিয়ে সভ্য করানো তার মহান দায়িত্ব, যাকে বলে হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন, সেই তাদেরই ভূমি থেকে উঠে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রুখে দাঁড়ালেন নিবেদিতা। নিজের তেজ দিয়ে আগলে রাখলেন ভারতের ঐতিহ্যকে, তার ধর্মকর্ম এবং সংস্কারকে। কালীপূজার বহু বিতর্কিত সাধনপদ্ধতির মধ্যে যে প্রকৃতি-অর্চনার বজ্রকঠিন অধ্যায় আছে, তাকে নমস্কার জানালেন। বললেন, ঈশ্বর শুভ ও অশুভ উভয়েই সমান ভাবে বিরাজ করেন। মহাকালীর যে করাল রূপ আমরা দেখি তা মিথ্যা মায়া, মরীচিকা, বিভ্রম। ওই রূপ দেখে যারা ‘না না’ বলে আঁতকে উঠে পিছিয়ে যায়, তারা অভাগা। তারা কালীর কোলে বসে কালীর মিঠে কথা শুনতে পায় না। যা তিনি দেখান, তা তিনি নন। ওই ভয়ংকর, ওই অমানিশা, ওই ত্রাস পেরিয়ে তবেই নিত্যানন্দময়ী কালীকে পেতে হয়। শক্তিপূজায় এ ভাবেই শক্তি মেলে। হ্যাঁ, এ পুজোর আশেপাশে অনেক শয়তানি জড়ো হয়েছে সত্যি। কিন্তু সে সব আগাছার ভয়ে কি আমরা নন্দনকাননটিকে ত্যাগ করতে পারি?

কালাপানির ও পার থেকে এক অচ্ছুৎ এসে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে দাঁড়িয়ে কালী নিয়ে এমন আবেগ ভরে কথা বলছে। কালীর চর্চা করছে। রক্ষণশীল সমাজে কী তুমুল ঝড়ই না উঠল। কেউ আবার চোখের জল ফেলে ধন্য ধন্য করে উঠল, এই মেয়ে তো দেখি ঈশ্বরের কথা পৃথিবীকে বলার জন্যই জন্মেছে। সেই সব শংসা-নিন্দার লেশমাত্র তাঁর জ্যোতির্বলয়ে প্রবেশই করতে পারল না। কারণ তিনি তখন কালীকে মেনেছেন, কারণ তাঁকে পেয়ে গিয়েছেন। কালীর সকল সন্তানদের ভালবাসাও সেই মায়ের সঙ্গে খেলারই অঙ্গ। তাঁর যাপন জুড়ে থাকেন মৃত্যুরূপা কালভৈরবী। বাগবাজারের ভাড়াবাড়ির উনুনের মতো গরম এক চিলতে ঘরে যখন দগ্ধে দগ্ধে চরম পরিশ্রম করেন, তখন ঈশান কোণে কালবৈশাখীর মেঘের আভাস দেখলে সব যাতনা ভুলে উঠে দাঁড়ান তিনি। ‘ওই তো! কালী! কালী!’ গরিব ঘরের অপুষ্ট দুধের শিশু তাঁর সামনে শেষ নিঃশ্বাস ফেললে, তার শোকাকুল মাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, বলেন, ‘চুপ করো। তোমার মেয়ে এখন কালীর কাছে!’ শ্রীশ্রীমাকে আনিয়ে নিজের বড় সাধের স্কুলের ভিতপাথর স্থাপনা করেন তিথি দেখে অমাবস্যায়, ঠিক সেই কালীপুজোরই দিনে। ‘আহা, এখানে পড়ে আমার মেয়েরা যেন জগন্মাতার আশীর্বাদটুকু পায়’— রুদ্রাক্ষ চেপে ধরে প্রার্থনা করেন সিস্টার।

আর কালীর পায়ে আত্মোৎসর্গের তত্ত্বকে সত্যি করে একটু একটু করে নিংড়ে দেন নিজের রক্ত। তাঁর কালীর জন্য। কালীর সন্তানদের জন্য। সকালে স্কুল চালান, দুপুরে খর রোদে ছাতা হাতে ছাত্রী খুঁজতে বের হন, বিকেলে মুখের ফেনা তুলে খাটেন রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। অতীত খুঁড়ে আবার যে ফিরিয়ে আনতে হবে ভারত সংস্কৃতির হীরের যুগ। সন্ধেয় বিপ্লবীদের শেখান স্বাধীনতার মানে। তার পর, রাত জেগে বই লেখেন। পর দিন কাকভোরে উঠে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে প্লেগের ব্যাধি তাড়াতে ছোটেন। অক্লান্ত কর্মযোগে তিলে তিলে শেষ হতে হতে সময়ের অনেক আগে নিবেদিতা আশ্রয় নেন বরফের কফিনে।

শক্তিপক্ষেই তাঁর পৃথিবীতে আসা। শক্তিপক্ষেই তাঁর চিরতরে চলে যাওয়া। আমরা শুধু পড়তে পাই দার্জিলিঙের হিমেল শ্মশানভূমিতে তাঁর সমাধির ওপর লেখা কনকনে বাক্যগুলো: ‘এখানে শান্তিতে শুয়ে আছেন তিনি, যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন— সিস্টার নিবেদিতা: ২৮ অক্টোবর ১৮৬৭-১৩ অক্টোবর ১৯১১।’

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita Social Work 150th birth anniversary
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE