উত্তরপ্রদেশের হিন্দু মহল্লায় গত লোকসভা ভোটের আগে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল একটি ছড়া। কী ছিল তাতে? “তদাদ বঢ়ানে কে লিয়ে চাল চলাই/ মুসলিম বনানে কে লিয়ে স্কিম বনাই/ ইক্কোঁ কো গলি গাঁও মেঁ লেকর ঘুমাতে হেঁ/ পর্দে কো ডাল মুসলিম অউরাত বিঠাতে হেঁ।” (জনসংখ্যা বাড়াতে, ভিন্ ধর্মের লোকেদের মুসলমান বানাতে ওরা স্কিম বানাচ্ছে। অলিগলিতে ওদের লোক ঘুরছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে মুসলমান বানাচ্ছে।) ‘চন্দ মুসলমানোঁ কি হরকতেঁ’ নামের এই ছড়া শুনিয়ে আরএসএস প্রচার করে, ভালবাসার ছলে হিন্দু মেয়েদের ফুসলিয়ে ধর্মান্তরিত করার এক কৌশল নিয়েছে মুসলমানরা। এই ঘোর ‘বিপদ’ থেকে নিজেদের ‘বাঁচাতে’ হোয়াটস্অ্যাপ, এসএমএস-এ এই ছড়া সংঘ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল।
এত দিন কট্টরবাদীদের ‘হিন্দু খতরে মে হেঁ’র প্রচারে ভারতের রাজনৈতিক হাওয়ায় যা ভাসছিল, সম্প্রতি কেরলের হাদিয়া মামলায় দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে সেই বিচিত্র এবং বিতর্কিত ‘লাভ জেহাদ’ শব্দবন্ধটিকে কার্যত মান্যতা পেয়ে গেল। ‘লাভ জেহাদ’? মুসলমান যুবকেরা নাকি পরিকল্পিত ভাবে হিন্দু মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করছে— এমনটাই অভিযোগ কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির৷
‘চন্দ মুসলমানোঁ কি হরকতেঁ’ কোনও নয়া আমদানি নয়। এ ছড়া লেখা হয়েছিল, সেই ১৯২৮ সালে। মুসলমানদের হাতে ‘অপহরণ’ হওয়া থেকে হিন্দু মেয়েদের ‘রক্ষা’ করতে উত্তর ভারতে ঠিক একই কায়দায় প্রচার শুরু করেছিল আর্য সমাজ ও অন্য হিন্দু পুনরুত্থানবাদী শাখাগুলো। একটা ঐক্যবদ্ধ সমসত্ত্ব অতীত এবং হিন্দু মেয়েদের নির্দিষ্ট ‘পবিত্র’ চরিত্র তৈরি করে জাতির পরিচয় গড়া এবং ‘অস্তিত্বরক্ষা’র দায়েই ছিল এই উদ্যোগ। সে সময়ের এবং আজকের এই ‘লাভ জেহাদ’-এর থিয়োরির প্রচারে এত সামঞ্জস্য যে বোঝা মুশকিল, কেউ আর্য সমাজের পুস্তিকা ‘হিন্দু স্ত্রীয়োঁ কে লুট কি
কারণ’ পড়ছেন, না কি ২০১৭ সালে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট!
দুই ন্যারেটিভেই মেয়েদের উপরে অত্যাচারের প্রসঙ্গ গৌণ। আসল কথা হচ্ছে: ‘ওরা’ ‘আমাদের’ মেয়েদের উপর ‘অত্যাচার’ করছে। এই ‘বিপদ’ থেকে ‘আমরা’ ‘আমাদের’ মেয়েদের ‘রক্ষা’ করব। মুজফফরনগর দাঙ্গা কিংবা মেরঠ গণধর্ষণ মামলার সময় উত্তরপ্রদেশে সংঘ পরিবার হিন্দুদের বোঝায়, দু’টিই আদতে মুসলমান ছেলেদের হিন্দু মেয়ে ধর্মান্তরকরণ বা ‘লাভ জেহাদ’-এর চেষ্টার ফল। সেই ‘জেহাদ’ ঠেকাতে সে দিন উত্তরপ্রদেশে সপ্তাহব্যাপী ১০ লক্ষ রাখি বিলিয়ে উৎসব করে আরএসএস-এর শাখা ধর্ম জাগরণ মঞ্চ। হিন্দু ছেলেরা মুসলমানদের হাত থেকে ‘বোনেদের’ ‘রক্ষা’ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
কেরলের অখিলা অশোকন নামে প্রাপ্তবয়স্ক ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়েটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ধর্মান্তরিত হাদিয়া বছর দুয়েকের মাথায় ম্যাট্রিমনি সাইট ঘেঁটে নিজের জন্য এক জন পাত্রও নির্বাচন করেন। জোর করে তাঁর মেয়েকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে বলে বিচার চেয়ে আদালতে ছুটেও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারছিলেন না হাদিয়ার বাবা। কিন্তু শাফিন জাহান নামে এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে হাদিয়ার বিয়ের পরেই কেরল হাইকোর্ট এক অভূতপূর্ব রায় দিল। বলা হল, এ দেশে নাকি অভিভাবকের বিপক্ষে নিয়ে গিয়ে হিন্দু মেয়েদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করে সিরিয়ায় জঙ্গি কার্যকলাপে নিয়োগ করার চক্রান্ত চলছে। অতঃপর চব্বিশ বছরের মেয়েটিকে পত্রপাঠ স্বামীর কাছ থেকে বাবার জিম্মায় ফিরিয়ে দেওয়া হল। শাফিন স্ত্রী-কে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলেন। উল্টে শীর্ষ আদালত সম্প্রতি আরও এক ধাপ এগিয়ে হাদিয়া ‘লাভ জেহাদ’-এর ‘শিকার’ কি না, এনআইএ-কে তদন্ত করে দেখতে বলল। এই ধরনের ঘটনা কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড কি না, তা-ও খুঁজে দেখতে বলল তারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাদিয়ার মতো প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের অন্য ধর্ম গ্রহণ বা পছন্দের পুরুষ নির্বাচনের মধ্যে এ দেশের কোন জাতীয় পর্যায়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে? সত্যিই কি এ রকম কোনও জেহাদি কার্যকলাপ চলছে এ দেশে, যেখানে মুসলমান ছেলেদের রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, কী ভাবে কোন হিন্দু মেয়েকে ফুসলিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy