নায়ক: দলিত অধিকার রক্ষার দাবিতে বাবাসাহেব অম্বেডকরের জন্মদিনে মোমবাতি মিছিল। কলকাতা, ১৪ এপ্রিল ২০১৮। ছবি: পিটিআই
বাবাসাহেব অম্বেডকর আপনি কার? আপনি কি বিজেপির? না কি মায়াবতীর? আপনি দলিতের, না কি আজ আপনি মনুবাদী ব্রাহ্মণেরই? সত্যি বলছি, আমি এখন খুব বিভ্রান্ত। আমাদের দেশে লোকসভা ভোট যখন জাগ্রত দ্বারে, ঠিক তখনই এ প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব ভীমরাও অম্বেডকর, আপনার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক কে?
নীল কোট পরা অম্বেডকর তাঁর ডান হাতের তর্জনী তুলে কী বলতে চান সেটা বোঝার চেষ্টা না করেই তাঁকে গৈরিক রঙে রাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরের দিন বহুজন সমাজ বাহিনী আবার তাঁকে নীলিমায় নীল করে দিয়ে এসেছে। বল্গাহীন বর্ণহিন্দু ভৈরব বাহিনী সংবিধান প্রণেতার মূর্তি ভেঙে দিচ্ছে। বেচারা যোগী আদিত্যনাথ! লৌহপিঞ্জরে অম্বেডকরকে বন্দি করে তাঁকে ভিভিআইপি-নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিয়েছেন।
১৯৭৮-এর ২০ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বিন্ধ্যেশ্বরী প্রসাদ মণ্ডলের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই কমিশনই মণ্ডল কমিশন নামে পরিচিত। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়ে দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত সেই রিপোর্ট আলমারি থেকে বার করে ধুলো ঝেড়ে বাজারে ছাড়লেন। ঝড় উঠল দেশ জুড়ে। মণ্ডলের বিরুদ্ধে আডবাণী নামলেন কমণ্ডলু নিয়ে। মণ্ডল-অস্ত্র দিয়ে যত না নিম্নবর্গের অভ্যুত্থান হল, তার চেয়ে বেশি হল হিন্দু অভ্যুত্থান। এই টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আডবাণী বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের হিন্দুত্বকে উচ্চবর্ণ-কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। আডবাণীর বঙ্গারু লক্ষ্মণকে সভাপতি করা থেকে মোদীর রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করা এক সুতোয় বাঁধা। ২০১৪-র ভোটে এই মেরুকরণের পূর্ণ ফসল তুলেছেন মোদী। তার পর থেকে অমিত শাহ দলিত কর্মীর বাড়িতে গিয়ে ভোজন সারছেন। মোদী অম্বেডকরের নামে মূর্তি, বাড়ি, রাস্তা, মিউজিয়াম নির্মাণ করে চলেছেন। তবু কেন গোটা দেশ জুড়ে দলিত অভ্যুত্থান?
দেখুন, ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্ম ও বিকাশের সামাজিক ভিত্তিভূমি রয়েছে। আরএসএস, পরবর্তী কালে জনসঙ্ঘ-বিজেপির সামাজিক ভিত্তিভূমি হল উচ্চবর্ণ, বিশেষত ব্রাহ্মণ নেতৃত্ব। আজ পর্যন্ত আরএসএস-এ কোনও দলিত সঙ্ঘপ্রধান হয়েছেন? ব্রিটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে অনৈক্য যাতে প্রবল না হয়, তার জন্য বাবাসাহেব গাঁধীজির সঙ্গে পুণে চুক্তির মতো বোঝাপড়া বার বার করেছিলেন। কিন্তু গাঁধীর হরিজন তত্ত্বের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের নিচু জাতকেও কাছে টানাকে উচ্চবর্ণের দাসত্ব বলেই মানতেন অম্বেডকর। আর বিজেপি? আজকের দিনে ঘোষিত হিন্দুত্ববাদী দল। সে দলের কান্ডারি কি জানেন, অম্বেডকর বলেছিলেন, জাত ব্যবস্থাকে ভাঙতে হলে বেদ ও হিন্দু শাস্ত্রকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। আর বিজেপি মানে তো ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ্য ধর্ম।
পাশ্চাত্যের সাদা-কালো জাতি-বর্ণ বিবাদের চেয়ে এ দেশে দলিত পরিচয়ের রাজনীতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে, কারণ ভারতে তো শুধু বর্ণাশ্রম বা জাতপাতভিত্তিক বৈষম্য নয়, এর মধ্যে মিশে গিয়েছে ধর্ম। বৌদ্ধ, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম বর্ণাশ্রমভিত্তিক হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকে কুঠারাঘাত করেছিল, হিন্দু সমাজের অবক্ষয় আটকাতে মধ্যযুগে ভক্তি আন্দোলন, চৈতন্যদেব থেকে কবীর, অস্পৃশ্য, দলিত, পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গ, ব্রাত্য হিন্দু সমাজকেও আত্তীকরণ করেছিল। কিন্তু তাতে দলিতের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া অসমাপ্ত থেকে যায়।
যত দিন যাচ্ছে ক্রমশ মনে হচ্ছে সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে নির্মিত এক ‘অচ্ছে দিন’-এর অবভাস শেষ সত্য হতে পারে না। এই মলমটি ব্যবহার করলে টাকে চুল গজাবে বলে ব্যান্ডেল লোকালে দশ দিন কোনও পণ্য চুটিয়ে বিক্রি করতে পারি, কিন্তু তার পর যখন দেখা যাবে টাকে একটি চুলও গজাল না, তখন আমার কী হবে? গণপিটুনির ভয়ে পালিয়ে রাজধানীতে চলে আসতে হবে। ও সব পোস্ট-ট্রুথ, পোস্ট-ফ্যাক্টরেরও আয়ুষ্কাল সীমিত। সভ্যতার পিলসুজের মর্যাদাকে যারা অবজ্ঞা করেছে, ইতিহাস কিন্তু বার বার তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে।
গত চার বছরে মোদী সরকারের রিপোর্ট কার্ড কী বলছে? এ দেশে দলিতের সংখ্যা ৩০ কোটির উপর। গড়ে ১৮ মিনিট অন্তর এক জন দলিতের উপর অত্যাচার হয়, গড়ে প্রতি দিন তিন জন দলিত কন্যা ধর্ষিতা হন। শতকরা ৩৭ ভাগ দলিত দারিদ্র সীমার নীচে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট, মোদী ক্ষমতায় আসার চার বছর পরও হাল অপরিবর্তিত। তাই প্রশ্ন ওঠে, এ কি পুজোর ছলে ভুলে থাকা? বাস্তবের জমিতে কী হয়েছে?
প্রাক-আর্য সভ্যতার বনবাসী অনার্য-অস্পৃশ্য-আদিবাসী-দলিত জনসমাজকে পরবর্তী আর্য হিন্দু সমাজ আত্তীকরণ করলেও হতদরিদ্র দলিত দলিতই থেকে গিয়েছে। মায়াবতী জনপ্রিয় হয়ে দলিত সমাজের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে ওঠেন। কিন্তু সে-ও তো শূদ্রাণীর ব্রাহ্মণায়ন। বাস্তবে দলিত সমাজের আর্থিক উন্নয়ন হল কই? সংস্কৃতায়ন হিন্দুধর্মের অবক্ষয় আটকালেও দলিত কণ্ঠস্বর আজও পূর্ণ প্রকাশিত হয়নি। এমনই হয়। সর্বহারা শ্রেণির যাঁরা নেতৃত্ব দেন সেই মধ্যবিত্ত কান্ডারিরাই বুর্জোয়া হয়ে যান। আর তাই দেখুন, রাজ্যে রাজ্যে চন্দ্রশেখর আজাদ, জিগ্নেশ মেবাণী, কানহাইয়া, হায়দরাবাদের রোহিত ভেমুলার মতো নবীন নেতাদের জন্ম হচ্ছে। গোটা দেশ জুড়ে দলিতের আত্মপরিচয় নির্মাণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠছে।
মনমোহন সিংহ তখন প্রধানমন্ত্রী। মনে আছে রাহুল গাঁধী তখন থেকেই প্রত্যন্ত গ্রামে নির্যাতিত দলিতদের বাড়ি চলে যেতেন। মাওবাদী এলাকায় বনবাসীদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে পরিবেশ রক্ষার কথা বলতেন। সে সময়ে রাহুলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। কত দিন আগের কথা। তখনই রাহুল স্বীকার করেছিলেন কোনও বড় রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই দলিতরা জাগছে। তিনি বলেছিলেন— আমি ওঁদের ওপর দাদাগিরি করার পদ্ধতির ঘোরতর বিরুদ্ধে, তবে সত্যি সত্যি ওঁদের পাশে থাকলে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জিত হবে। জানি না, ২০১৯ সালের ভোটের রাজনীতি কী হবে। এটা বোঝা যাচ্ছে, ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন দলিত ভাষ্যের নির্মাণ হচ্ছে। দলিতরা বলছেন, আমাদের আর ‘মাই-বাপ’ সংস্কৃতি দরকার নেই। আমাদের লড়াই আমরাই বুঝে নেব।
২০১৪ সালের নির্বাচনে এক দিকে হিন্দু ভোটের সুসংহতি, অন্য দিকে মোদী ব্র্যান্ড, এটাই ছিল বিজেপির কৌশল। আজ প্রতিবাদী দলিত কণ্ঠস্বর শুনে উদ্বিগ্ন মোদী উনিশের রণকৌশল বদলাচ্ছেন। হিন্দু ভোটকে জাতপাতের ভিত্তিতে আর ভাগ করলে চলবে না। উত্তরপ্রদেশে যাদব, মুসলমান, দলিত ‘কম্বো’-র কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা যথার্থই শঙ্কার কারণ। শূদ্রাণীর ব্রাহ্মণায়ন হয়েছে বটে। তবু মায়াবতীর দলিত ভোটব্যাঙ্ক আজও সজীব। দলিত ক্ষমতায়নের অসম্পূর্ণ বিপ্লব যদি ভোট-বাক্সে মোদীকেই চ্যালেঞ্জ করে? বিজেপিতে সর্বজনগ্রাহ্য দলিত নেতার বড়ই অভাব। ওবিসি হয়েও মোদী দলিত মুখ নন। তাই রামবিলাস পাসোয়ান থেকে রামদাস আঠওয়ালেও এখন মহামূল্যবান। খোল-কত্তাল-সহ অম্বেডকর পুজোপালনের ঘটাও বেড়েছে ভয়াবহ।
বেচারা বাবাসাহেব! কত দুঃখে যে তিনি বৌদ্ধ ও সাম্যবাদী হয়ে গিয়েছিলেন, তা যদি বিজেপি নেতারা বুঝতেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy