গঙ্গার ঘাট দূষিত হইল, কান ঝালাপালা হইল, তিন যুবক প্রাণ হারাইলেন। গণেশপূজা দেখাইয়া দিল, উৎসবের শহরে সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করিতে পুলিশ ও প্রশাসন অপ্রস্তুত, বা অনাগ্রহী। মূর্তির উচ্চতার সীমা হইতে সাউন্ডবক্সের শব্দসীমা, পাড়ায় পাড়ায় সব বিধিই লঙ্ঘন করিয়াছেন উদ্যোক্তারা। পুলিশ কাহাকেও নিবারণ করে নাই, গ্রেফতারও করে নাই। বরং সংবাদে যে ঘটনা প্রকাশিত হইতেছে, তাহা ভয়ংকর। বাইশ ফুটের গণেশমূর্তি লইয়া বাজে কদমতলা ঘাটে যাইবার পথে রেললাইন অতিক্রম করিতে চাহিলে কর্তব্যরত পুলিশ তাহাদের বাধা দেয়। সেই বাধা অগ্রাহ্য করিয়া রেলের বিদ্যুৎবাহী তার সরাইতে গিয়া তিন যুবক মৃত। পুলিশ ক্লাবের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করিতে ব্যর্থ। এমন ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত অসংখ্য। ‘ডিজে বক্স’ ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু তাহা চালাইয়া শব্দবিধি লঙ্ঘন করিয়া অগণিত প্রতিমা বিসর্জন হইয়াছে। কেন পুলিশ তাহা নিবারণ করিতে পারে নাই, তাহারও ইঙ্গিত মিলিয়াছে— প্রভাবশালী নেতাদের ক্লাবের সদস্যরা পুলিশকে মান্য করিতেছে না, পুলিশও বাধা দিতে অনিচ্ছুক। এমনকী ভবিষ্যতে যে শব্দবিধি লঙ্ঘনের পুনরাবৃত্তি হইবে না, তেমন ভরসাও মেলে নাই, কারণ পূজা কমিটিগুলির সঙ্গে বৈঠকে পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার গণেশপূজায় শব্দবিধির লঙ্ঘন বিষয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন নাই।
কলকাতা পুরসভা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা পুলিশ, যথেচ্ছ গঙ্গা দূষণেও কেহ বাধা দেয় নাই। নদীতে যে সকল পূজাসামগ্রী ফেলিবার নিয়ম নাই, সবই নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। কর্তাদের যুক্তি, আয়োজকেরা অনুমোদন নেন নাই। তাই তাঁহারা প্রতিমার উচ্চতা বা শব্দের ডেসিবেল-সীমা কিংবা বিসর্জনের ঘাটে দূষণ নিবারণ লইতে পারেন নাই। ইহার পর সম্ভবত কর্তারা বলিবেন, ডাকাত-খুনিরা এমন বেয়াদব হইয়াছে যে অনুমতি না লইয়া খুন-রাহাজানি করিতেছে। অনুমতি না লইয়া বৃহদাকারে অনুষ্ঠান হইতে পারিল কী করিয়া? আয়োজকদের দাপাদাপি গোটা শহর টের পাইয়াছে, কেবল কর্তারাই পান নাই? তাঁহারা কেন আন্দাজ করিতে পারেন নাই, বিসর্জনের দিন কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন হইতে পারে? আঠারো ফুটের অধিক উচ্চতার মূর্তি যে নির্মিত হইয়াছে, গত বৎসরের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ হইয়াছে গণেশপূজার সংখ্যা, ডিজে বক্স বাজিতেছে, কিছুই কর্তাদের নজরে পড়ে নাই?
পূর্বে কয়েকটি নির্দিষ্ট উৎসব ব্যতীত অপর কোনও আয়োজন জনজীবন বিপর্যস্ত করিতে পারিত না। এখন অপরিচিত, স্বল্পপরিচিত, যে কোনও উপলক্ষে প্যানডেল বাঁধিয়া, মাইক চালাইয়া, দুই-তিন দিনের জলসা চলিতে থাকে। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বার্থে আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণ করিতেছে পুলিশ ও প্রশাসন, এমন ইঙ্গিত মেলে নাই। কিন্তু গণেশপূজায় যে প্রকার সার্বিক বিশৃঙ্খলা দেখা গেল, তাহা আইনের শাসন লইয়াও প্রশ্ন তুলিয়া দিল। আশঙ্কা হয়, ইহার পর রাস্তা অবরোধ করিয়া মণ্ডপ নির্মাণ হইতে বিসর্জনে বিকট শব্দের সংগীত, সকল বিষয়ে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হইবে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাহাদের আশ্রিতদের পুলিশ-প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করিবে না, এই বার্তা জনসমাজে ছড়াইলে তাহার ফল হইবে সার্বিক অরাজকতা। রাজ্য সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হইতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy