সম্প্রতি হিন্দু হস্টেলের ১০৩ নম্বর ঘরে এক পথকুকুরের দেহ মিলল। গর্ভবতী কুকুরটিকে কেউ ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দু’টি সন্তানের জন্ম দিয়ে, আরও দু’টি প্রসবের আগেই মারা গিয়েছে জুলি। মায়ের দুধ, উত্তাপ না পেয়ে একটি শাবকও মারা গিয়েছে।
শহরে পথপশুর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব। অনেকে পথের কুকুর-বেড়ালদের আদরযত্ন করাই মানবিক কর্তব্য মনে করেন। অন্যরা তাদের উপদ্রব মনে করেন, তাদের তাড়াতে পারলেই খুশি হন। এই দ্বিতীয় দলের কিছু লোক কেবল মুখে ঘৃণা দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকছেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে নিরীহ প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার দৃশ্য। সারমেয় ধর্ষণ, গরু-ছাগল ধর্ষণ, গর্ভবতী কুকুরকে পিটিয়ে হত্যা, কুকুরছানাদের বস্তায় পুরে মুখবেঁধে অন্যত্র ফেলে দিয়ে আসা, পথপশুদের গায়ে গরম জল ঢেলে দেওয়া, মাংসে বিষ মিশিয়ে কুকুরদের খাইয়ে দেওয়া, অ্যাসিড অ্যাটাক নিত্যই ঘটে চলেছে। নীলরতন সরকার হাসপাতালে কুকুরছানাদের উপর নির্মম প্রহারের ঘটনার ভিডিয়ো দেখে সকলে শিউরে উঠেছিলেন।
পথপশুদের ওপর অত্যাচার যেমন বেড়েছে তেমনই বাড়ির পোষা সারমেয়টিকে বেঘর করে দিতেও মানুষজন আজ পিছিয়ে নেই। ল্যাব্রাডর, গোল্ডেন রিট্রিভার, লাসা, সেন্ট বার্নাড, জার্মান শেফার্ড, নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নামীদামি প্রজাতির কুকুরেরাও। খেয়ালের বশবর্তী হয়ে ফুটফুটে কুকুরছানা কেনার পর দু’দিনে শখ মিটে যায় অনেকের। ঘরবন্দি পোষ্যরা তখন অবহেলা-অত্যাচারের শিকার হয়। পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করে কলকাতার বুকে বারবার পথে নেমেছেন পশুপ্রেমীরা। প্ল্যাকার্ড হাতে পদযাত্রা করেছেন, থানার সামনে ধর্নায় বসেছেন। তবে তাঁদের উপরেও প্রায়ই আঘাত নেমে আসে। হামেশাই পশুপ্রেমীদের শুনতে হয়, ‘‘রাস্তার পশুদের জন্য এত চিন্তা, কই গরিবের জন্য তো কিছু করেন না?” অনেকের মতে, পথের পশুদের ভালবাসা একটা ভড়ং।
কিন্তু যাদের জন্য এই লড়াই, সেই পথপশুরা কতটা নিরাপদ?
পথপশুদের জন্য বর্বরতামুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার স্বার্থে দেশ তথা রাজ্যের প্রাণী কল্যাণ বোর্ড প্রতিটি রাজ্যে প্রতিনিধি হিসাবে এক জন করে আধিকারিক নিযুক্ত করেছেন। গোটা দেশে সক্রিয় রয়েছে পশুদের অধিকার সুরক্ষায় নিয়োজিত কিছু সংস্থা। যেমন মানেকা গাঁধী প্রতিষ্ঠিত, ‘পিপল ফর অ্যানিম্যালস,’ যার শতাধিক শাখা রয়েছে। রয়েছে ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস’-এর পশু আশ্রয়স্থল ও পশু হাসপাতাল। ভারতীয় সংবিধানের ৫১-এ(জি) ধারায় বলা হয়েছে পরিবেশ, বনভূমি, প্রাণিসম্পদ এবং জলসম্পদ রক্ষা করা এক জন প্রকৃত নাগরিকের কর্তব্য। কেউ স্বেচ্ছায় অসহায়ের সেবা-শুশ্রূষা করলে, প্রাণীকে খাদ্যদান করলে সেই ব্যক্তিকে বাধা দেওয়া অপরাধ। তার জন্য শাস্তিও হতে পারে।
ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ৪২৮ ও ৪২৯ নম্বর ধারা, এবং প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ আইন (প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট, ১৯৬০) অনুযায়ী কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীকে তার স্থায়ী এলাকা থেকে তাড়ানো, আঘাত করা, ইচ্ছাকৃত ভাবে গাড়ি চাপা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ— নগদ দু’হাজার টাকা জরিমানা এবং চার বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। পথের কুকুরদের উপর কেউ অত্যাচার করলে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা যায়। কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে বিশেষ সুরক্ষাও পায় পথের কুকুরেরা।
আইন নির্যাতন থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে, কিন্তু মানুষ-পশু সংঘাত বন্ধ হবে কী করে? পশুসেবীদের কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। কেবল খাওয়ানো আর আদর করা যথেষ্ট নয়। ভারতের প্রাণী কল্যাণ বোর্ডের নির্দেশানুসারে ব্যাপক হারে অ্যান্টি-র্যাবিস টিকাকরণ ও নির্বীজকরণই পথপশুদের সুস্থ আর নিরাপদ জীবন দিতে পারে। স্বেচ্ছাসেবক পশুপ্রেমীদের অবশ্যই এই দু’টি কাজে অংশ নিতে হবে। পথকুকুরের জন্মহার যত কমবে, তাদের মধ্যে অপুষ্টি, সংক্রামক ব্যাধি এবং পথদুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বা মৃত্যুর যন্ত্রণা ততই কমবে। আহত পথপশুকে তার স্থায়ী এলাকায় রেখে চিকিৎসা করাই শ্রেয়। কোনও কারণে এনজিও-র সাহায্য নিলেও পশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর তাকে তার এলাকায় ফিরিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক।
নির্বীজকরণের পরেও সুস্থ কুকুরকে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে হবে। রাস্তা নোংরা না করে, খাবারের পাত্র ব্যবহার করে, খেতে দিতে হবে। অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি না করে পথপশুদের খেতে দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে খাদ্যদাতাকে খাবার খাওয়ানোর জায়গাটি পরিষ্কারের দায়িত্বও নিতে হবে। শিশুদের পার্ক, অফিস ও বসতবাড়ি সংলগ্ন স্থান, এবং যে সব জায়গায় মানুষের ভিড় বেশি, সেখানে পথপশুদের খেতে দেওয়া ঠিক নয়। পশুসেবীরা ব্যক্তিগত তথ্য জমা দিয়ে প্রাণী কল্যাণ বোর্ড থেকে পথপশুদের আঞ্চলিক কেয়ারটেকারের আই কার্ডও সংগ্রহ করতে পারেন। পথপশুদের যত্নেরও নিয়ম আছে। সেগুলি মেনে চললে মানুষ প্রতিবেশীর সঙ্গে সংঘাত এড়ানো সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy