Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ছাত্রকল্যাণ: ওরা আর আমরা

ইউনিয়নের আদর্শ ছাত্রকল্যাণের (‘স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার) দায়িত্ব পালন, ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানো। নতুন চাকরিতে ঢুকেও আমরা একই কারণে অফিস-ইউনিয়নে যোগ দিই, রাজনীতি করতে না চাইলেও।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৭ ০৭:০০
Share: Save:

উচ্চ-মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাসখানেক হল কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে আঠারো পেরনো এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে। প্রথম বর্ষের এই ছাত্রছাত্রীদের অনেকেরই কলেজে ঢুকে প্রথম কাজ হল ইউনিয়নে যোগ দেওয়া। আলোচনার খাতিরে দলবাজি, রাজনীতি, জোরজুলুম, দাঙ্গা, ঘেরাও ইত্যাদি ঋণাত্মক ভাবমূর্তি সরিয়ে রেখে কলেজ ইউনিয়নকে শুধু যদি ছাত্র-পরিষেবা হিসেবেই ভাবি, তা হলে দেখা যাবে বাজারি অর্থনীতির যে কোনও পরিষেবার মতোই এখানেও আছে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য, যার এক দিকে গ্রাহক আর অন্য দিকে পরিবেশক। ইউনিয়ন নামক পরিষেবা যাঁরা ‘বিক্রি’ করেন তাঁদের প্রয়োজন গ্রাহক ধরা, অতএব কলেজে ঢোকামাত্রই নবীনদের বরণ করে নেওয়া হয়, তাঁদের বোঝানো হয় কলেজ জীবনের, এমনকী কলেজের বাইরের যে কোনও সমস্যা সমধান করতে ইউনিয়নের দাদা-দিদিদের জুড়ি নেই। অন্য দিকে, চাহিদাও আসে একই যুক্তিতে— গ্রাহক অর্থাৎ নতুন ছাত্রছাত্রীরা সম্যক বোঝেন কলেজে সমস্যা হবেই, অগত্যা শুধুমাত্র বিমা করানোর মতোই ইউনিয়নের সদস্যপদ নেওয়া ভাল, বোনাস হিসেবে মিলবে ফিল্ম-ক্লাব থেকে শুরু ইন্টারকলেজ স্পোর্টস বা বাৎসরিক কলেজ ফেস্ট!

ইউনিয়নের আদর্শ ছাত্রকল্যাণের (‘স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার) দায়িত্ব পালন, ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানো। নতুন চাকরিতে ঢুকেও আমরা একই কারণে অফিস-ইউনিয়নে যোগ দিই, রাজনীতি করতে না চাইলেও। প্রায় দেড়শো বছর ধরে সারা পৃথিবীতে এ ভাবে শ্রমিকস্বার্থ দেখার ভার তো ইউনিয়নেরই। তা হলে একই যুক্তিতে ছাত্রকল্যাণের দায়িত্বও যে ছাত্র-ইউনিয়ন নেবে তাতে আশ্চর্য কী!

তবু, আঠারো বছরের এক সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মনে প্রশ্ন জাগে, ছাত্রকল্যাণের দায়টা আসলে কার— কলেজ-ইউনিয়নের না কি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের? এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা আমাদের দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল, তুলনায় পাশ্চাত্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের গোড়ায় শুধু নয়, সারা বছর ধরেই, বিশেষত প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ওয়েলফেয়ারটাই চিন্তা ও আলোচনার প্রধান বিষয়। সেখানে ইউনিয়ন আছে, তবে তাদের কাজ আলাদা, ছাত্রকল্যাণের দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রায় দেড় শতক আগে বিলেতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ধাঁচে গড়ে ওঠা আমাদের রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সব প্রশাসনিক ব্যবস্থাই পুরনো ইংরেজ আমলের আদলে, অথচ এ কালে আর আমরা ওদের ভাল-টা শিখি না।

পাশ্চাত্যের অনুসরণে কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সমাধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনার আগে ছাত্রকল্যাণের বিষয়গুলো অথবা কলেজ জীবনের সমস্যাগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। অর্থনীতির সংজ্ঞা ব্যবহার করে এই দুই প্রকার সমস্যার নাম দেওয়া যাক প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত এবং পাবলিক বা যৌথ। আপাতত শুধু যৌথ সমস্যার সমাধান নিয়ে কথা বলব, ব্যক্তিগত সমস্যার কথা পরে কখনও বলা যাবে।

কলেজের যে সমস্যাগুলো অনেককে ভোগাচ্ছে সেটাই যৌথ সমস্যা। নানা ধরনের যৌথ সমস্যা হতে পারে: শিক্ষা সংক্রান্ত বা অ্যাকাডেমিক, যেমন লেকচারারের কথা বা নোটস বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, কিংবা নন-অ্যাকাডেমিক, যেমন আগামী পরীক্ষার দিন বাস চলবে না অথবা ক্যান্টিনের জল খেলে পেটের গোলমাল হচ্ছে বা হস্টেলের টেবিল-টেনিস বোর্ড ভেঙে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু সমস্যার আকার আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও সমাধানের প্রেক্ষিতে তাদের যৌথ সমস্যার দলে ফেলা উচিত, যেমন প্রেসিডেন্সির সাম্প্রতিক স্যানিটারি ন্যাপকিনের সমস্যা— জিনিসটা প্রাইভেট গুড হলেও, কলেজের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা পাবলিক, কারণ সমাধান হলে অনেকের কল্যাণ।

এ বারে বলা যাক ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াও কীভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সব যৌথ সমস্যার মোকাবিলা করা যেতে পারে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রশাসনিক কাজ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নানান কমিটি আছে, যেমন বিভাগীয় স্তরে বোর্ড অব স্টাডিজ বা কলেজ স্তরের ডিনস’ ফোরাম ইত্যাদি। এগুলোতে হয়তো নাম-কা-ওয়াস্তে ছাত্র-প্রতিনিধিও আছেন, তবে তাঁরা হলেন ইউনিয়নের নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, রাজনীতি সেখানে মুখ্য, ছাত্রকল্যাণ নয়! সেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে ছাত্রদের ‘কনসালটেশন’ প্রায় অসম্ভব।

তুলনায়, বিলিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটি খুঁটিনাটি সমস্যার বিষয় নিয়ে সত্যিকারের আলোচনার জন্য নানা তৃণমূল স্তরের কমিটি রয়েছে, যেমন প্রথম বর্ষের পড়াশোনা কেমন চলছে বা নতুন সিলেবাসে কী করা উচিত তা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক একসঙ্গে মিটিং করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমতার নীতি কী হবে তা স্থির করার কমিটিতে নানা স্তরের ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে ডাকা হয়। সেখানে যোগদানকারী ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব করেন না, রাজনৈতিক দলের তো প্রশ্নই নেই। তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই ছাত্র-প্রতিনিধি, যে কেউ যে কোনও সময় এগিয়ে আসতে পারেন, ইউনিয়নের মাধ্যমে নয়। এই সব মিটিংয়ে সমস্যার কথা মুখ ফুটে বললেই সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু হয়। প্রতিবাদমঞ্চ, ধরনা, ঘেরাও তাই অনাবশ্যক।

প্রসঙ্গত, আমরা ভাবি কলেজ ইউনিয়নের এক বড় কাজ হল ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা— কলেজ-প্রাঙ্গণেই ঝান্ডা তোলার শিক্ষা লাভ করা উচিত। আমরা ভুলে যাই, মিছিল বা ঘেরাও করা ঠিক কাজের রাজনীতি নয়। বিদেশের এই কমিটি প্রক্রিয়ার পার্শ্বফল হিসেবে কিন্তু আমরা সহজেই আরও ভাল নেতা তৈরি করতে পারি। বিলেতের প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বা মে-রা এ ভাবেই বড় হয়েছেন। একই ভাবে, মার্ক্সবাদ নিয়ে আলোচনা, বিতর্কসভায় যোগদান করেই বামপন্থী হওয়া যায়, কোন রাজনৈতিক দলে নাম লেখাতে হয় না। সেটাই করে দেখানো আমাদের কলেজ ইউনিয়নের কাজ ও দায়িত্ব হতে পারে।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE