Advertisement
০৩ মে ২০২৪

নাগরিক সমাজ দুর্বল বলেই সম্মোহনের জাল ছড়ায়

উদার আধুনিক মন দু’হাত তুলে সাধুবাদ জানিয়েছিল ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ আদালতের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ সমাজকে আইনি স্বীকৃতিদান। তৃতীয় লিঙ্গের সমর্থনে এই পিটিশন কিন্তু এনেছিল ডেরা সচ্চা সৌদা সংগঠন।

বিস্ফোরণ: প্রশাসনকে সরাসরি হিংসাত্মক চ্যালেঞ্জ জানাল ডেরা সচ্চা সৌদা-র অনুগামীরা। পঞ্চকুলা, হরিয়ানা, ২৫ অগস্ট। ছবি: এএফপি

বিস্ফোরণ: প্রশাসনকে সরাসরি হিংসাত্মক চ্যালেঞ্জ জানাল ডেরা সচ্চা সৌদা-র অনুগামীরা। পঞ্চকুলা, হরিয়ানা, ২৫ অগস্ট। ছবি: এএফপি

অভিজিৎ কুণ্ডু
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

হরিয়ানার পঞ্চকুলায় যে ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব আমরা দেখলাম, আধুনিক মানসে তা একেবারেই অভাবিত। যৌন হেনস্তা, ধর্ষণকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ডেরা গুরু গুরমিত সিংহ রাম রহিম ইনসানের অগণিত ‘অনুগামী’। যুক্তিবিদ্যায় আলোকিত আধুনিক মন ভেবে নিতেই পারে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিম্নবর্গের আস্ফালন ছাড়া এর মধ্যে কিছু নেই।

দারুণ বিস্ময় ভারত নামে এই দেশটির মধ্যে। আধুনিকীকরণের অগ্রণী শ্রেণি সব সময়েই ভাবতে চেয়েছে, আধুনিকতা বনাম অনাধুনিক, লৌকিক বনাম অলৌকিক, কল্পিত-অলীক বনাম মোহমুক্তি এমন সব দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব। অথচ খেয়াল করেনি যে এই ডেরা বা নানা ধর্মীয় মার্গের সামাজিক নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছে উচ্চশিক্ষিত নানা পেশাদার মানুষ। ইঞ্জিনিয়ার, প্রশিক্ষিত ত্রাণকর্মী থেকে ডাক্তার/প্যারামেডিক-এর সক্রিয় অংশগ্রহণে গুরমিত সিংহ গড়ে তুলেছেন ধর্মীয় ডেরার পাশাপাশি ‘ওয়েলফেয়ার ফোর্সের’ পাকাপোক্ত সংগঠন। সামাজিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে এদের সদস্যরা।

উদার আধুনিক মন দু’হাত তুলে সাধুবাদ জানিয়েছিল ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ আদালতের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ সমাজকে আইনি স্বীকৃতিদান। তৃতীয় লিঙ্গের সমর্থনে এই পিটিশন কিন্তু এনেছিল ডেরা সচ্চা সৌদা সংগঠন। অর্থাৎ? এক দিকে ধর্মসংস্কারাচ্ছন্ন জীবনদর্শন, অন্য দিকে লৌকিক-সংস্কারমুক্ত দিনযাপন। অদ্ভুত মিশ্রণ।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এই বিশেষ ডেরাটির প্রায় ছয় কোটি অনুরাগী। উত্তর-পশ্চিম ভারতের বর্ধিষ্ণু দুই রাজ্য হরিয়ানা আর পঞ্জাবে এই ডেরাকে বলা যেতে পারে বিকল্প সামাজিকীকরণের ঘাঁটি। সাচ্চা সত্যের পবিত্রস্থানের প্রধান আশ্রম হরিয়ানার সিরসায় হলেও মূল ভিত্তিভূমি হল প়ঞ্জাব। ‘সবুজ বিপ্লব’খ্যাত এই ভৌগোলিক অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক চালচিত্রটি বেশ নাটকীয়।

এই অঞ্চলের কথা উঠলে আমাদের সামনে কী কী ইমেজ ভেসে ওঠে? বিস্তৃত চাষের জমি— গেঁহু, মকাই, ডাল, সর্ষের খেত, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চাষজমি, ট্রাকটারে রংবেরঙের পাগড়ি পরা সুখী চাষি, হেভি-ডিউটি পাম্পের জল সেচসমৃদ্ধ সবুজ বিপ্লবের সমৃদ্ধশালী পীঠস্থান। উনিশশো আশির দশক জুড়ে ছিল খালিস্তানের জঙ্গি শিখ রাজনীতি, আর পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের কাছে তার পরাজয়।

এই সব ইমেজের ফাঁকে ফাঁকেই আমরা খুঁজে নিতে পারি ডেরা সংগঠনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বুঝে নিতে পারি, কী ভাবে এই অঞ্চলের দৃষ্টি আকর্ষণকারী উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে নাগরিক জীবনের শূন্যতা। চকমকে আলোর রোশনাই-এর নীচে এক অস্থিরতা। রয়েছে ‘উড়তা পঞ্জাব’, ড্রাগের নেশায় বুঁদ বৃহত্তর যুবসমাজ। কৃষক আত্মহত্যার ভয়ংকর প্রবণতা। কে জানে, বেপরোয়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে উর্বর জমি নিংড়ে ফেলারই নিয়তি কি না এই বেপরোয়া দিনযাপন। অথচ এক সময়ে পঞ্জাবে বাম-গণতান্ত্রিক বা মানবাধিকারকেন্দ্রিক সংস্কৃতির যথেষ্ট সম্ভাবনাময় উপস্থিতি ছিল। আশির দশকের পর তা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ আইডেনটিটি রাজনীতি বনাম প্রবলতর রাষ্ট্রশক্তির দাপাদাপির পর নাগরিক সমাজ ক্রমশই অসহায় আর দুর্বল হয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে আস্তে আস্তে মূলধারার ধর্মীয় পীঠস্থান গুরুদ্বারের দখল চলে গিয়েছে উচ্চ শিখ সম্প্রদায়ের হাতে। বড় জমির মালিক, জাঠ সম্প্রদায়ের বাড়বাড়ন্তের পাশাপাশি প্রান্তিক হয়ে গিয়েছে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া বর্গ। অবহেলিত দলিত শ্রেণি আর জাঠ প্রতাপের কাছে পিছিয়ে পড়েছে অনুন্নত শ্রেণি। তাদেরই আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে এই সব নানা ডেরা। উচ্চবর্গীয় অনুশাসন বর্জিত এই ডেরাগুলি অনেক নমনীয়, প্রায় একটা সমান্তরাল স্বতন্ত্র ভিন্ন সমাজ। প্রচলিত ধর্মচর্চার থেকে আলাদা এদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। অনেক বেশি জাগতিক আর ব্যবহারিক।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন সব ডেরার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষক আর জনপ্রিয় হল এই ডেরা সচ্চা সৌদা, যার তৃতীয় ধর্মগুরু গুরমিত সিংহ রাম রহিমের কুকর্ম নিয়ে আপাতত আলোড়ন। নানা অপকর্মের মধ্যে প্রায় পনেরো বছর পুরনো এই যৌন অপরাধের মামলার রায় যদি জনসমক্ষে না আসত, আমাদের অনেকের আড়ালেই চলত গোটা সমাজ-জোড়া এই সম্মোহনী জাল বিস্তার।

খেয়াল করতে হবে, যৌন-অপরাধে দোষী সাব্যস্ত এই ধর্মীয় গুরুর ডেরায় কত অসংখ্য মহিলা অনুগামী আর শিষ্যা। কেন যান তাঁরা? হয়তো ডেরাকেন্দ্রিক জীবন-শৃঙ্খলার আশ্বাসবাণী আর চর্চায় বাড়ির পুরুষদের বেপরোয়া জীবনযাপন রুখতে। হয়তো লাগামছাড়া নেশার পিছনে ছোটা থেকে সেই পুরুষদের ফিরিয়ে আনতে। পুত্রসন্তান লাভের ‘মন্নত’ (মনপ্রাণ দিয়ে যা চাওয়া হয়) চাইতে। সামন্ত-পুরুষতান্ত্রিকতায় আক্রান্ত এ এক বিচিত্র, গভীর মনন। তাই, এক ভয়ানক ধর্ষক/প্রতারকের সাজা হচ্ছে বলে প্রতিহিংসায় উন্মত্ত জনতার মধ্যে এত সংখ্যক মহিলা ভক্ত!

অন্য দিকে, পুরুষদের কাছে ডেরার মূল আকর্ষণ: ধর্ম, বর্ণ, জাতপাতের বেড়া ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা। মূলধারার সমাজে নানা ভাবে ব্রাত্য ও প্রান্তিক মানুষের নিরাপত্তা আর সংসর্গের আধার হয়ে ওঠে এই রাম রহিমের ডেরা। মৌখিক ভাবে এখানে সকলেরই ‘ইনসান’। ‘ফেথ-হিলার’রা একটাই দাওয়াই সমানে আউড়ে যান, ‘ভগবানের কাছে সব মানুষই সমান।’ এই বুলিই তাঁদের সাফল্যের সিঁড়ি। যে দেশে রাষ্ট্র বা সমাজ, কারও কাছে মানুষ সমান নয়, তার বোধহয় এই ভবিতব্য।

ডেরার এই সামাজিক নির্মাণের সঙ্গে যদি জুড়ে দেওয়া যায় গুরমিত সিংহের অবতারসুলভ কৌশলী ব্যক্তিত্ব, তা হলে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে এই সংগঠনের ভেতরকার রহস্য। চমৎকৃত হওয়ার মতো পরিস্থিতি, বাস্তবকে ভেঙেচুরে এক অতিবাস্তব। চোখ ধাঁধানো ‘সাম্রাজ্য’ আর অতিমানবিক উপস্থাপনায় তিনি বাস্তবকে উল্টে দেওয়ার কৌশল জানেন। আর অনিশ্চয়তাময় বাস্তবজীবনে ক্লান্ত মানুষ তাতে সমানেই সম্মোহিত হয়ে পড়ে।

ধরা ছোঁওয়ার বাইরে এই আকর্ষণ এত প্রবল বলেই আবার দানসম্পদ আর প্রতারণার ঢল। সংখ্যা আর বৈভবের জোরেই এত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। ডেরার রাজনৈতিক যোগসাজশ, পৃষ্ঠপোষকতার নিদর্শন কেবল তো এই সরকারের আমলেই নয়। সামগ্রিক ভারতীয় রাজনীতিতে ‘গডমেন/উইমেন’ আর রাজনৈতিক সম্পর্কের ঘনত্ব যে এই প্রথম আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা-ও নয়।

আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির মধ্যেই ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছিল নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার আর সামাজিক অধিকার। নাগরিক আর রাজনৈতিক অধিকারের সফল পরিণতি পাওয়ার কথা ছিল সামাজিক অধিকার লাভে। কথা ছিল, সামাজিক নিরাপত্তা আর কল্যাণমূলক প্রকল্পের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সে সব কিছু হয়নি। তাই শূন্য জমিতে জন-উন্মত্ততা অতিবাস্তবতার আশ্রয় নেয়। গজিয়ে ওঠে ফেথ-হিলিং সমাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE