কোনও যোগগুরু, আচার্য বা বাবা-র নিদান নয়, খোদ নরেন্দ্র মোদী সরকারের আয়ুষ মন্ত্রকের অধীন একটি পর্ষদ তাদের সাম্প্রতিক পুস্তিকায় পরামর্শ দিয়েছে, সুস্থ সন্তান পেতে হলে গর্ভবতীদের মাংস-ডিম খাওয়া এবং যৌনতা থেকে দূরে থাকতে হবে! ‘বাসনা, রাগ, ঘনিষ্ঠতা, কাম, বিদ্বেষ এবং আমিষ ভক্ষণ— সবই নাকি সুস্থ সন্তান হওয়ার পথের কাঁটা।
এহেন নির্দেশ নিয়ে দেশ জুড়ে ছিছিক্কার, লেখালিখি, প্রতিবাদ শুরু হলে পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিবৃতি দেয় যে, তারা কোনও নির্দেশ দেয়নি, কেবল কিছু পরামর্শ দিয়েছে। নির্দেশ হোক বা পরামর্শ, সরকারি কর্তাদের মানসিকতাটা পরিষ্কার। এই মানসিকতার উৎসও অজানা নয়। মাসখানেক আগেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) স্বাস্থ্য শাখা ‘আরোগ্যভারতী’ ভারত জুড়ে শিবির করে দম্পতিদের সঙ্গমের মাহেন্দ্রমুহূর্ত, যথাযথ গর্ভসঞ্চার পদ্ধতি ও গর্ভস্থ ভ্রূণের যত্নের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিল। তখনও কিছু শোরগোল হয়েছিল।
তবে আয়ুষের আওতাধীন পর্ষদ বা আরোগ্যভারতীর আর দোষ কোথায়? গলদটা তো একেবারে গোড়ায়, এবং তা সংশোধনের কোনও চেষ্টা কোনও তরফেই নেই। কী ভাবে বলবান, বুদ্ধিমান, গৌরবর্ণ এবং উন্নতমানের সন্তান পাওয়া যাবে তার বিস্তারিত পদ্ধতি আমাদের দেশের ‘ব্যাচেলর অ্যান্ড আয়ুর্বেদ মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ (বিএএমএস)-র সরকারি পাঠ্যক্রমে বছরের পর বছর ধরে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা দেখলে চোখ কপালে ওঠে। কী করলে দম্পতি পুত্রসন্তান পাবেন এবং কী করলে সন্তান কন্যা হবে, তারও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সেই পাঠ্যক্রমে। সরকারেরই তৈরি করা ‘প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-নেটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিকস অ্যাক্ট’কে (পিসিপিএনডিটিএ) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকারেরই তৈরি পাঠ্যক্রমে হবু আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা দিব্যি সরকারি আয়ুর্বেদ কলেজে ‘গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ বদল করার কৌশল’ পড়ছেন এবং শিখছেন!
পরবর্তী কালে চিকিৎসকেরা এই অর্জিত বিদ্যা হাতেকলমে প্রয়োগ করবেন না এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা সরকার জারি করেনি। বরং যারা এই পাঠ্যক্রম ঠিক করে সেই ‘সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ান মেডিসিন’-এর সচিব বনিতা মুরলি কুমার যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘আয়ুর্বেদ হল বেদের অংশ। বেদের ভিতর যদি বলবান সন্তান, গৌরবর্ণ সন্তান, পুরুষ বা স্ত্রী সন্তান হওয়ার বিভিন্ন ‘রিচুয়াল’ বা প্রথা এবং পদ্ধতির কথা লেখা থাকে তা হলে আয়ুর্বেদের পাঠ্যক্রমে সে সব রাখতেই হবে। শাস্ত্রের বিধান তো বদলাতে পারব না।’’ এবং, ‘‘পাঠ্যক্রমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া শেখানো হচ্ছে না। কোন কোন পদ্ধতি (রিচুয়াল) অনুসরণ করলে সন্তান ছেলে কিংবা মেয়ে হতে পারে সেটা শাস্ত্র অনুসারে পড়ানো হচ্ছে মাত্র। এতে সবসময় কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও হতে পারে। আমরা এটা কাউকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছি না।’’ অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে, আমার সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে অমুক শিকড় বেটে খেলে গর্ভের সন্তান ছেলে হবে বা দুধের সঙ্গে তমুকটা মিশিয়ে খেলে বাচ্চার রং ঝকঝকে হবে। আমি সেই ‘প্র্যাকটিস’কে সটান আয়ুর্বেদ ডাক্তারির পাঠ্যক্রমে ঢুকিয়ে দিলাম! অথচ কাউকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করলাম না!
বিএএমএস-এর তৃতীয় বর্ষের পাঠ্যক্রমে প্রসূতিতন্ত্র নামে অধ্যায় রয়েছে। তার একটি অংশে রয়েছে ‘পুংসবনবিধি।’ হবু আয়ুর্বেদ ডাক্তারদের চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা এবং বাগভট্টের অষ্টাঙ্গহৃদয়ম্ থেকে এই বিধি সম্পর্কে পড়ানো হয়।
তাতে কী রয়েছে?
চরকসংহিতা পড়া যাক: চাঁদের সঙ্গে যখন পুষ্যা নক্ষত্র মিলিত হবে তখন দু’টি ধান্যমাসের সঙ্গে গর্ভবতী মহিলাকে দই মিশিয়ে খেতে হবে। অথবা গোশালায় জন্মানো কোনও বটবৃক্ষের পূর্ব বা উত্তরমুখী ডালের থেকে দু’টি গোটা কুঁড়ি নিয়ে তার সঙ্গে সাদা সর্ষে বেটে খেতে হবে। একই ভাবে জীবক, ঋষভক, অপমার্গ ও সহচর নামের ভেষজ-বাটার সঙ্গে ফোটানো দুধ মিশিয়ে খেতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, চাঁদ ও পুষ্যা নক্ষত্রের মিলনের সময় তাঁকে এক অঞ্জলি জলে ‘কুড্যকিটক’ নামে এক ধরনের ছোট কিট বা ‘মৎস্যক’ বা এক ধরনের ছোট মাছ নিয়ে খেতে হবে। সোনা-রুপো বা লোহা দিয়ে পুরুষমূর্তি বানিয়ে সেটা জল দিয়ে ধুয়ে সেই জলের সঙ্গে দই ও দুধ মিশিয়ে আঁজলা ভরে খেতে হবে। শালিধান সেদ্ধ করতে হবে এবং গর্ভবতী মহিলা ঘরের চৌকাঠে বসে সেই ধানসেদ্ধ হওয়ার ধোঁয়া নাকে টানবেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজে শালিধান বাটার সঙ্গে জল মিশিয়ে সেই মিশ্রণ তুলোয় ডুবিয়ে তা ফোঁটা ফোঁটা নিজের ডান নাকের ফুটোয় ঢালবেন। ভ্রূণের দু’মাস বয়সের ভিতরেই এই পদ্ধতিগুলি পালন করতে হবে। কারণ, এর পরেই ভ্রূণের লিঙ্গ পরিস্ফুট হয়ে যায়। তখন আর পাল্টানো যাবে না।
সুশ্রুত সংহিতায় আবার লেখা রয়েছে, পুত্রসন্তান লাভের জন্য পুরুষটি এক মাস কোনও নারীসঙ্গম করবেন না। সেই সময় তিনি ভাত খাবেন খাঁটি ঘি ও দুধ সহযোগে। মহিলাটিও পুরুষসঙ্গম করবেন না। এবং নিয়মিত শরীরে ভাল করে তেল মাখবেন। ঘি ও মাসকলাই খাবেন। এর পর যে-দিন তাঁদের মিলন হবে সেই রাতে সঙ্গমের সময় ব্রাহ্মণরা জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করবেন। সেই মন্ত্র যেন সঙ্গমরত নরনারীর কানে যায়। এক মাসের ‘ব্রহ্মচর্য’ শেষ হওয়ার পর চতুর্থ, ষষ্ঠ, অষ্টম এবং দ্বাদশ দিনে মিলিত হলে সন্তান ছেলে হবে। কিন্তু মিলন যদি পঞ্চম, সপ্তম, নবম বা একাদশ দিনে হয় তবে সন্তান হবে কন্যা।
বাগভট্টের অষ্টাঙ্গহৃদয়ম-এ ‘পুংসবনবিধি’ অংশে লেখা আছে, ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী, গর্ভস্থ ভ্রূণ কোন লিঙ্গের হবে তা নির্ভর করে পূর্ব জন্মের কর্মের উপর। তবে অনেক সময় দৈব-র থেকেও বর্তমানের কর্ম শক্তিশালী হয় ও কিছু কর্মপদ্ধতিতে ভ্রূণের লিঙ্গ বদলানো যায়। কিন্তু তা করতে হবে ভ্রূণের এক মাস বয়সের মধ্যে। পুত্রসন্তানের জন্য লক্ষ্মণা গাছের শিকড়ের রস দুধে মিশিয়ে নাকে ঢালতে বা খেতে আর জীবনীয় গোত্রের ওষুধ খেতে ও শরীরে লাগাতে বলা হয়েছে।
হবু আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের এই সবই পড়ানো হচ্ছে শুনে চমকে উঠেছেন হিউম্যান জেনেটিক্স বিজ্ঞানীরা। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের হিউম্যান জেনেটিক্স বিভাগের গবেষক পার্থপ্রতিম মজুমদার যেমন বলেছেন, ‘‘জাইগোট-এর তো লিঙ্গ নির্ধারিত হয়েই থাকে। সেটা আবার পরিবর্তিত হবে কী করে?’’ রাজ্যের আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের একাংশের তরফ থেকে অবিচল চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকে আবার দাবি করেছেন, তাঁরা এই সব পদ্ধতির কথা জানলেও কখনও প্রয়োগ করেন না। কিন্তু তার মানে এই নয়, কেউই প্রয়োগ করছেন না।
চন্ডীগড়ের ‘পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ থেকে উত্তর ভারতের প্রায় ২০০ গর্ভবতী মহিলার উপরে করা একটি সমীক্ষা রিপোর্ট ২০০৭ সালে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কমিউনিটি মেডিসিন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, এর মধ্যে ৪৬% মহিলা গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ বদলের জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধ খেয়েছেন এবং পুংসবনবিধি পালন করেছেন। এক শ্রেণির আয়ুর্বেদ চিকিৎসক এর রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে ডিগ্রিধারী এবং ভুয়ো চিকিৎসক— দু’রকমই রয়েছেন। ওই সব জায়গায় স্থানীয় মুদির দোকানগুলিতেও ভ্রূণের লিঙ্গ পরিবর্তন করে দেওয়ার দাবি করা একাধিক আয়ুর্বেদিক ওষুধ পাওয়া যায়। কারণ, প্রচুর চাহিদা। এই রকম কিছু ওষুধ পরীক্ষা করেও গবেষকেরা দেখেছিলেন তাতে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন রয়েছে।
দেশের সরকারই যদি ডাক্তারদের পাঠ্যক্রমে ‘পুংসবনবিধি’ রাখতে চান তা হলে অন্যদের আর দোষ কী? সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে রয়েছে।
শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy