টেরেসা মে-র হাতে ঘর সামলাইবার জন্য তিন বছর সময় ছিল। কিন্তু তাঁহার ধৈর্য কম। দেখা যাইতেছে, বিবেচনাবোধও। আইনসভায় তাঁহার কনজার্ভেটিভ পার্টির অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তিনি ভাবিলেন ভোট করিয়া আসনসংখ্যা বাড়াইয়া লইবেন এবং নিশ্চিন্ত মনে দুই বছরের নির্ধারিত সময়ে ব্রেক্সিট সম্পন্ন করিবেন। ফল হইল বিপরীত, আসনসংখ্যা কমিয়া ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাটুকুও হাতছাড়া হইল। এখন উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের প্রায় অজ্ঞাতপরিচয় একটি দলের কাঁধে ভর দিয়া সরকার গঠনের দাবিপত্র হাতে প্রধানমন্ত্রীকে রানির দরবারে ছুটিতে হইতেছে। লজ্জার মাথা খাইয়া তিনি বলিতে পারিতেন, এই নির্বাচনে তাঁহার দলের জনসমর্থন তো বাড়িয়াছে! পাটিগণিতের হিসাবে কথাটি মিথ্যা নহে। গত নির্বাচনে কনজার্ভেটিভরা ৩৭ শতাংশ ভোট পায়, এ বার পাইয়াছে ৪২.৪ শতাংশ। কিন্তু ইউকিপ ও এসএনপি-র মতো দলের ভোট প্রচুর কমিয়াছে, এবং তাহার সিংহভাগ গিয়াছে বিরোধী লেবার পার্টির ঝুলিতে, তাহাদের ভোট ৩০ হইতে বাড়িয়া ৪০ শতাংশে পৌঁছাইয়াছে। ফলে, ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের পরিচিত লীলা এ বার ঘরের ময়দানেই! পাটিগণিত যাহাই বলুক, রাজনীতির সত্য সহজ ও স্পষ্ট। টেরেসা মে আপন বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছেন।
প্রধানমন্ত্রী তর্ক তুলিতে পারেন, এপ্রিল মাসে যখন তিনি অন্তর্বর্তী নির্বাচন ঘোষণা করেন, তখন জনমতসমীক্ষায় তাঁহার দলের পক্ষে সমর্থনের হার লেবার পার্টির তুলনায় বিস্তর বেশি ছিল, এত দ্রুত ছবিটি এত পালটাইবে, তিনি জানিবেন কী করিয়া। এই প্রশ্নেই তাহার উত্তর নিহিত। প্রথমত, জনমতসমীক্ষা আর নির্বাচন এক নহে। কেবল সমীক্ষার উপর নির্ভর করিয়া ভোট করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় নহে। যে সমর্থনে এত দ্রুত ধস নামিতে পারে, তাহার গুণমান বুঝিবার ক্ষমতাই রাজনীতিবোধের শর্ত। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী প্রচারের কয়েক সপ্তাহে যে ভাবে জনমতসমীক্ষাতেও পট পরিবর্তিত হইয়াছে, তাহা জানাইয়া দেয়, প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর মন বুঝিতে পারেন নাই। বিশেষত, তরুণ সমাজের। তরুণ-তরুণীরা দুই বছর পূর্বের নির্বাচনের তুলনায় এ বার অনেক বেশি মাত্রায় ভোট দিয়াছেন এবং সিংহভাগ লেবার পার্টিকে ভোট দিয়াছেন। শাসক দলের এই পরাজয়ের পিছনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণটি কিন্তু তরুণ প্রজন্মের ভোট। কনজার্ভেটিভ পার্টি তরুণ-তরুণীদের সমর্থন হারাইয়াছেন, সেই সমর্থন জয় করিয়াছে লেবার।
বস্তুত, লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। দুই বছর আগে আপন দলের অন্দরমহলের প্রবল আপত্তি ও প্রতিরোধ অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর সমর্থক-গোষ্ঠীর জোরে দলীয় নেতৃত্ব দখল করিবার পর হইতে করবিন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দলকে তাঁহার বামপন্থী নীতি গ্রহণ করাইতে তৎপর থাকিয়াছেন, পাশাপাশি সেই নীতি দেশের সর্বত্র নাগরিকদের মধ্যে প্রচার করিয়া দলীয় সংগঠন জোরদার করিয়াছেন। এই উদ্যোগ ও উদ্যম নির্বাচনে সুফল আনিয়া দিয়াছে। নীতিগুলি আগমার্কা রাষ্ট্রবাদ এবং জনমনোরঞ্জনের। শিক্ষায় স্বাস্থ্যে আবাসনে ভর্তুকি, নূতন করিয়া জনপরিষেবার জাতীয়করণ, সম্পন্ন নাগরিক এবং শিল্পবাণিজ্যের উপর কর বৃদ্ধি— এক কথায় সেই পুরানো সমাজতন্ত্রী মানসিকতার প্রত্যাবর্তন, যে মানসিকতার অচলায়তন ভাঙিয়া মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনকে উদার অর্থনীতির রাজপথে আনিয়াছিলেন। ডেভিড ক্যামেরন এবং তাঁহার উত্তরসূরি টেরেসা মে ব্রেক্সিটের মৌতাতে ভুলিয়া নাগরিকদের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের, ক্ষোভ এবং চাহিদা বুঝিতে পারেন নাই। সেই চাহিদা ও ক্ষোভ ভাঙাইয়া জেরেমি করবিন জয়ধ্বজা উড়াইতেছেন। তাঁহার পশ্চাৎমুখী মানসিকতা ও নীতি জনপ্রিয় হইতেছে। দুর্ভাগ্য ব্রিটেনের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy