প্রতীকী ছবি।
বর্ষ আসে বর্ষ যায়। প্রশ্নগুলি থাকে। এক বৎসর আগে গত জানুয়ারির বারো তারিখে গোটা দেশ এক আশ্চর্য ঘটনা দেখিয়াছিল। সুপ্রিম কোর্টের চার জন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ বিচারপতি সংবাদমাধ্যমের সামনে নিজেদের উদ্বেগ ও আশঙ্কা তুলিয়া ধরিতেছিলেন। ইতিমধ্যে পৃথিবী বার্ষিক চক্র ঘুরিয়া আসিয়াছে। বিচারপতিদের উদ্বেগ যে কতটা সঙ্গত ও সময়োচিত ছিল, তাহা বুঝা গিয়াছে, অথচ কোনও সমাধান মিলে নাই। সম্প্রতি বিচারক লোয়ার বিতর্কিত মৃত্যু লইয়া শাসক ও বিরোধী দলের আদানপ্রদানে আবারও সেই প্রশ্নকণ্টক তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা জন্মিল— কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর সমালোচনার যে উত্তর দিয়াছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি, তাহাতে বিচারপতি লোয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু লইয়া কোনও প্রতিক্রিয়া নাই কেন। এই নীরবতার অর্থ কি তবে ইহাই যে, বিচারপতি লোয়া বিষয়ে তথ্য এতটাই সংবেদনশীল যে রাজনৈতিক চর্চায় তাহা আনিতে জেটলি অনিচ্ছুক? বিষয়টি অতি গুরুতর, কেননা যে সোহরাবুদ্দিন শেখ ভুয়া হত্যা মামলায় মুম্বইয়ের বিশেষ সিবিআই আদালত বাইশ জন অভিযুক্তকে সম্প্রতি বেকসুর মুক্ত করিয়া দিয়াছে, সেই মামলাটিরই শুনানি হইয়াছিল বিচারপতি লোয়ার এজলাসে। কেবল তাহাই নহে। লোয়ার মৃত্যুর পরে এই মামলায় জড়িত আইনজীবী শ্রীকান্ত খান্ডালকর ও জেলা আদালতের বিচারক প্রকাশ থম্বড়েরও রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। সব সময় সব তথ্য নাগরিক সমাজ সমান ভাবে অবগত থাকে না। কিন্তু রাজনীতিকরা যখন তাহা সামনে লইয়া আসেন, তখন নাগরিক সমাজের ভিতরে তৈরি হওয়া উদ্বেগ দূরীকরণের দায়টি শাসক পক্ষেরই। লোয়া-মৃত্যুর ক্ষেত্রে সেই দায় স্বীকারে বিশেষ অনীহা, ও তজ্জনিত প্রশ্নকুয়াশার ঘনঘটায় দেশের বিচারবিভাগের স্বাধীন কর্মপরিসর বিষয়ে যে গভীর অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হইয়াছে, তাহা দুর্ভাগ্যজনক।
দুর্ভাগ্য, কেননা স্বাধীন ভারত বহু সঙ্কটপর্ব দেখিয়া আসিলেও বিচারপতিদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা লইয়া এমন আশঙ্কা আগে দেখে নাই। এক বৎসর আগে সেই ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত চার বিচারপতির কথা হইতেও এই সঙ্কেতই মিলিয়াছিল। কাহারও প্রতি সরাসরি অভিযোগ-বাণ বর্ষিত হয় নাই, বর্ষণের প্রয়োজনও হয় নাই। বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুর পর তাঁহার পরিবার রাজনৈতিক চক্রান্তের ইঙ্গিত দিয়াছিল, বিভিন্ন শিবির হইতে শাসক দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের একাংশের প্রতি তর্জনী সঙ্কেত করা হইয়াছিল। কপিল সিব্বলের মতো আইনজীবীরা সরাসরি বলিয়াছিলেন, লোয়ার মৃত্যুর সহিত শ্রীকান্ত ও প্রকাশ থম্বড়ের মৃত্যুর প্রত্যক্ষ যোগ আছে। কিন্তু আর কিছু হয় নাই। প্রশ্নের উত্তরে মিলিয়াছে নীরবতা। এবং নীরবতার সূত্র ধরিয়া আরও নীরবতা। তথ্য বা প্রমাণের অভাবে যেখানে প্রতিষ্ঠা হয় যে সোহরাবুদ্দিন শেখ নিহত, কিন্তু কে তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে তাহা জানিবার উপায় নাই— সেখানে নীরবতা পালন করা ছাড়া উপায় কী।
নীরবতার অবকাশে আর একটি ভয়ানকতর মৃত্যুর প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করিতেছে এই দেশ। তাহা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির মৃত্যু। গণতন্ত্রের স্তম্ভ বলিয়া স্বীকৃত যে বিচারবিভাগ, তাহার অন্দরেই যদি এত রকম আশঙ্কাজনক প্রশ্ন সঞ্চারিত হয়, তাহার অন্দর হইতে টেবিল টানিয়া যদি শীতবিকালের পড়ন্ত আলোয় জরুরি ভিত্তিতে আহূত সাংবাদিক বৈঠকে সেই প্রশ্নসঞ্চারের কথা সর্বজনগোচর করিতে হয়, তবে দেশের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলির কথা আর বিশদ করিয়া বলিবার প্রয়োজন হয় না। গত কয়েক বৎসরে ভারত যে ঘটনাবহুল রাস্তা হাঁটিয়া আসিয়াছে, সেই রাস্তায় ইহাই সর্বাপেক্ষা বড় সঙ্কট-কলঙ্ক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy