মুখ্যমন্ত্রীর যে সংস্কারের প্রচেষ্টা থেকে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব শুরু হল, বাংলা ভাষাকে দার্জিলিং-কালিম্পং পার্বত্য অঞ্চলে ও তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে আবশ্যিক তৃতীয় ভাষা করার সেই প্রস্তাব আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৬০-৬১ সালের কথা। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ও ঠিক এমনই একটা চেষ্টা করেছিলেন, আর পশ্চিমবঙ্গের হিমালয়-সন্নিহিত লোকালয়গুলিতে তার সূত্রে প্রবল অশান্তির বন্যা বয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে দিন রাজ্য সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারি ভাষা আইন পাশ হয় ১৯৬১ সালে। নেপালি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে রাজ্যের তিনটি পার্বত্য সাব-ডিভিশনে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে আবার এই অঞ্চলে একটি বৃহত্তর ভাষা আন্দোলন তৈরি হয়, নেপালি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলভুক্ত করার দাবিকে কেন্দ্র করে। ১৯৭৭ সালে নেপালি-ভাষী ভারতীয়রা একটা বড় গোছের ধাক্কা খান প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের আমলে। সেই তখন থেকেই কেবল বাংলায় নয়, ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসবাবসকারী নেপালিদের মধ্যে ভাষা-আন্দোলন জনপ্রিয় ও সক্রিয়।
শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে নেপালি ভাষাকে অন্যতম প্রধান ভারতীয় ভাষারূপে অষ্টম তফসিলভুক্ত করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উনিশশো পঞ্চাশের দশকেই এই জরুরি বিষয়টি উত্থাপন করেন, আর ১৯৭৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি নেপালি ভাষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভাষা রূপে তার বাইশটি ভাষার তালিকায় জায়গা দেয়। দার্জিলিং এবং তার সন্নিহিত অঞ্চল কিন্তু কখনওই নিজেকে পুরোপুরি বাংলার সংস্কৃতির অংশ বলে মেনে নিতে পারেনি। গোর্খাদের মধ্যে এই ভাবনা অনেক কাল আগে থেকেই বেশ গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর সতীর্থরা যে এ কথা বুঝতেন, গোর্খাল্যান্ডের উপর ১৯৮৬ সালের তাঁদের প্রকাশিত শ্বেতপত্র থেকে সেটা বোঝা যায়।
এ বারের আন্দোলনটি কিন্তু অনেক দিক থেকেই মধ্য-আশির দশকের আন্দোলন ও ২০০৭-১০ সালের সংকটের থেকে চরিত্রগত ভাবে আলাদা। সরকারের নানা ধরনের প্রকল্প আর নীতি সত্ত্বেও, গোর্খা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তা (আইডেন্টিটি) তৈরির দৃঢ় বাসনা চার দিকে স্পষ্ট, ভাল করে চোখ মেলে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। রাজ্য সরকার যত বেশি সেটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, ততই সেটা বেড়ে চলে। আলাদা সংস্কৃতি, আলাদা ঐতিহ্য, আলাদা ইতিহাস, আলাদা ভূগোল, সব নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বরাবরই মনে করে, নেপালিভাষী নাগরিকরা যেন সব সময়েই এ রাজ্যে প্রান্তিক, আলাদা। বাংলা-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির চাপে গোর্খা সত্তা যেন সব সময়েই চাপা পড়ে আছে।
এই প্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ বারের ঘোষণাটিকে বুঝতে হবে। গোর্খা মানুষদের মধ্যে অনেক শতকের একটা ঐক্যসূত্র আছে। মুখ্যমন্ত্রী যখন থেকে নানা ধরনের জনজাতীয় সত্তাকে সামনে এনে সেটা ভেঙে ফেলার উদ্যোগ করে যাচ্ছেন, তখন থেকেই কিন্তু দার্জিলিং ও ডুয়ার্স অঞ্চলে গোর্খা একতার আবেগ টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে সিভিক বডি নির্বাচন উপলক্ষে যে নির্বাচনী প্রচার হল, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু কিছু নেতা অবিবেচকের মতো কথাবার্তা বলে গোর্খাদের চটিয়ে দিলেন। ভোটের বাক্সে তার উত্তরও হয়তো পেলেন। মিরিকের ছোট মিউনিসিপ্যাল বোর্ডেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারত না যদি না দলটির মধ্যেই অত রকমের ভেতরকার খেয়োখেয়ি থাকত। আর এক বার প্রমাণ হল, গোর্খা ঐক্যের জোর বেশ বেশি, চট করে কোনও রাজনৈতিক দলই সেটা ভাঙতে পারবে না।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, জিটিএ কিন্তু এ ভাবে ব্যর্থ হত না, যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমানে তাদের ভেতরকার কাজেকর্মে নাক না গলাতেন, যদি তিনি মোর্চার সঙ্গে আর একটু বেশি সহযোগিতা করতেন। কিন্তু তিনি জিটিএ চুক্তি মেনে সব বিভাগের ক্ষমতা দিয়ে দিতেও রাজি হননি, আবার জিটিএ-কে স্বাধীন ভাবে কাজ করতেও দেননি। ভানু জয়ন্তী উৎসবও তাঁর নেতৃত্বেই পালন করতে হয়েছে, উপায় নেই। গত বছর যখন দার্জিলিং চৌরাস্তা মোড়ে বিরাট জাঁকজমক করে সরকারি ভানু জয়ন্তী উৎসব পালিত হচ্ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা পার্টি প্রোগ্রাম চলছে, যেখানে বিমল গুরুঙ্গ জিটিএ-র প্রধান কর্মপরিচালক হওয়া সত্ত্বেও এক কোণে কোনও রকমে একটি আসন পেয়েছেন, কেউ তাঁকে পাত্তাও দিচ্ছে না। সে দিনও কিন্তু গোর্খারা আলোচনা করেছিলেন কী দারুণ অসম্মান এই ঘটনার মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো জানেনও না, তিনি ও তাঁর দলের এই সব দাম্ভিক আচরণ পাহাড়ি মানুষকে ভেতর থেকে কতখানি চটিয়ে দিয়েছে।
এখন তো আর গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন কেবল এই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, দেশের অন্যান্য জায়গায় যত গোর্খা আছেন, এমনকী বিদেশেও— সকলেই তাঁদের জীবন দিয়ে এই আন্দোলন চালাতে চাইছেন। কোনও ভাবেই যাতে ডিজিএইচসি বা জিটিএ-র মতো কোনও রাজনৈতিক সমঝোতা না হয়, জোরদার সেই আলোচনা চলছে। পুলিশ আর প্যারামিলিটারি বাহিনী যে ভাবে নির্বিচারে মানুষের উপর দমন চালিয়ে যাচ্ছে, দেখেশুনে নেতারা যে যেখানে ছিলেন একত্রিত হচ্ছেন— না, এমনটা চলতে পারে না। অথচ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া সাধারণ মানুষ এখনও মোটের উপর শান্ত। তাঁরা এখনও প্রতি দিন গণতান্ত্রিক মতেই মিটিং মিছিল করে চলেছেন। সরকারি মতে কিন্তু এরা সকলেই জঙ্গি। গোটা অঞ্চলে ইন্টারনেট সার্ভিস এক মাসের উপর বন্ধ। মানুষ প্রাত্যহিক খবর চালাচালিটুকুও করতে পারছে না, তথ্যের অধিকার, বাক্-স্বাধীনতা ইত্যাদি নীতির কথা না-হয় ভুলেই যান! কাশ্মীরের মতো জায়গাতেও ইন্টারনেট সার্ভিস হয়তো টানা তিন-চার দিনের বেশি বন্ধ হয় না, অথচ দার্জিলিং অঞ্চল এক মাসের উপর যোগাযোগের দিক দিয়ে অবরুদ্ধ। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy