সংঘাতপন্থা: রাস্তায় দুধ ঢেলে সরকারের কৃষি-ঋণ নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন মহারাষ্ট্রের কৃষকরা। আহমদনগর, ১ জুন। ছবি: পিটিআই
কা লপেঁচা’ বিনয় ঘোষ কথিত একটা গপ্পো মনে পড়ছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কাহিনি। রাজপুত্র রোহিত দীর্ঘ কাল চলে চলে ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য ঘরের দিকে চলেছেন। পথে দেবরাজ ইন্দ্র বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বললেন, হে রোহিত। যে বসে থাকে, তার ভাগ্যও বসে থাকে। যে শুয়ে পড়ে, তার ভাগ্যও শুয়ে পড়ে। যে এগিয়ে চলে, তার ভাগ্যও এগিয়ে চলে। অতএব এগিয়ে চলো। ঘুমিয়ে থাকাটা হল কলিকাল। জাগলেই দ্বাপর। উঠে দাঁড়ালেই ত্রেতা। আর এগিয়ে চলাই হল সত্যযুগ। দেবরাজ ইন্দ্রের ভাষায় আমরা আসলে সত্যযুগের মানুষ। এগিয়ে চলাই ধর্ম। বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, ভাগ্যিস বৈদিক যুগের কোনও ঋষি বা রাজপুত্র আজ আর বেঁচে নেই। তা না হলে আমাদের এখনকার এগিয়ে চলার এই ভয়ানক বিদ্যুৎগতি দেখে তাঁরা শিউরে উঠতেন।
মন্দসৌরে পুলিশের গুলি চলার পর দিল্লিতে বসে একগুচ্ছ বিশেষজ্ঞ খুব গম্ভীর হয়ে বোঝাচ্ছেন, গরিব চাষিরা অপসৃত। কৃষি ক্ষেত্রে অতি উৎপাদন। নয়া কৃষক সমাজ তাই দাম পাচ্ছে না। এই সংকটে কৃষিকে পরিত্যাগ করে চাষিরা আসছে শিল্পে। চাই কৃষির ‘মেকানাইজেশন’ আর আধুনিকীকরণ।
বিশেষজ্ঞ দল যে সবটাই ভুল বলছেন এমন নয়। গ্রামীণ অর্থনীতি প্রাণহীন হয়ে উঠছে। আরও সত্যি কথা, কৃষকের সঙ্গে রাষ্ট্রের তথা সরকারের যে সাবেকি শ্রেণি-সংঘাত ছিল, সেই দৃশ্যও অনেক বদলে গিয়েছে। আজ কৃষক ও রাষ্ট্রের মধ্যের সম্পর্কটিও পুনঃসংজ্ঞায়িত হচ্ছে। কত যোজনা, কত জনকল্যাণকামী প্রকল্প। এই কারণেই উত্তরপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কৃষিঋণ মকুব। কিন্তু দিল্লিতে বসে বিশেষজ্ঞরা সমাজ বদলের যে ছবিটি তাড়াহুড়ো করে তুলে ধরছেন, তা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে রামা কৈবর্ত্য অথবা গফুর মিঁঞারা। কৃষি ঋণ হোক আর ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া শিল্প ঋণ, এ সব ক্ষেত্রে দেশের বড় বড় ‘একআনি-দু’আনি’ শিল্পপতিরা ক্ষমতার অঙ্গুলিহেলনে যথেষ্ট ঋণ পাচ্ছে না। আর গরিব প্রান্তিক মানুষ কী পাচ্ছে? নন-কর্পোরেট পুঁজির দুনিয়ায় অসংগঠিত গরিব মানুষ, খণ্ডজমির ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের অস্তিত্বই আমরা স্বীকার করছি না।
ব্যাঙ্ক ডিফল্টারদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিলেও সরকার গত তিন বছরে যে সব বড় বড় শিল্পপতি ঋণ নিয়েও টাকা ফেরত দেননি, তাদের বিরুদ্ধেই বা কী ব্যবস্থা নিয়েছে? ব্যাঙ্কের কাজই তো ঋণ দেওয়া। আর ঋণ ফেরত না দিলে শাস্তি প্রদান। কোন রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলনে আজ বিজেপি জমানায় একইভাবে রাঘব বোয়ালরা পার পেয়ে যাচ্ছেন? আর আজ যারা গরিব মানুষ তাদের বিরুদ্ধেই সরকার খড়্গহস্ত? সব কৃষকই যেমন গরিব কৃষক নয়, তেমন সব ঋণগ্রহণকারী শিল্পোদ্যোগীই ইনডাস্ট্রিয়ালিস্ট নয়। সব-কা-সাথ সব-কা-বিকাশের মোদী সরকার তাই ধনী-বিরোধী যে জামাটা পরেছিলেন তার ছোপ ছোপ রং জলে ধুয়ে গিয়েছে। জামাটা এ বার খুলে ফেলাই ভাল।
উন্নয়নের সর্বরোগহরা বটিকার কথা ঘোষণা করে আমরা ভারত নামক দেশটির মধ্যেই আসলে দু’টি দেশ গড়ে তুলছি। একটা আলোর দেশ, অন্যটি অন্ধকারের। সমস্যাটা কোথায় হয়েছে জানেন? আপনারা দ্বারভাঙার সন্তোষ কুমারকে চেনেন না। আমরা সাংবাদিকরাও মূলত শহরকেন্দ্রিক, দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে বসবাস করে ভারতের নাড়ি টেপা ডাক্তার হতে চাই। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। বিহারের দারভাঙা জেলা থেকে দিল্লি এসে চাকরি খুঁজছেন সন্তোষ কুমার। ছোট ছোট দুটো জমি ছিল ওঁদের। ধান হত। যথেষ্ট বৃষ্টি হয়নি। ভাল চাষ হয়নি। এলাকায় পঞ্চায়েত মাফিয়ারা আছে। ফসল যেটুকু হয়েছে তাও কেনার লোক নেই। ওই চাল অন্য কাউকে দিয়ে তার বদলে কিছু আলু নিয়েছেন ওঁর মা। বাবা মুচিগিরি করতে পটনা গিয়েছেন ভাগ্য অন্বেষণে। মা আর বউ খেতে কাজ করছেন। সন্তোষ দিল্লি এসেছেন গাড়ি চালিয়ে রোজগার করবে বলে। দিল্লির রাজপথে আকাশের নীচে শুচ্ছেন। গ্রামের মাটির ঘরে বিদ্যুৎ নেই। জলের সংকট। আর মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য ডাক্তার বদ্যি করতে গিয়ে বহু টাকা ধার বাজারে। সন্তোষ ভাবছেন, দিল্লিবাসী হয়ে যদি সরকারি গরিব হয়ে যেতে পারেন। বস্তিতে বেআইনি জবরদখল হয়ে থাকবেন। বিদ্যুৎ-জল বিনে পয়সার ভোজ, রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত গরিব হওয়াটাই আপাতত ওঁর জীবনের লক্ষ্য। সন্তোষ কুমারকে প্রাক্তন রাজস্ব সচিব নন্দু কুমার সিংহ চেনেন না। তাই তিনি কিন্তু দিল্লিতে বসে বোঝাচ্ছেন, রাস্তায় দুধ ঢেলে দিয়ে মহারাষ্ট্রের চাষিরা আহমদনগরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, অতএব ওঁরা ধনী। এ আন্দোলন, ধনী কৃষকদের সমস্যা।
স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশেও বলা হয়েছিল, চাল-ডাল উৎপাদনের বদলে ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে অগ্রাধিকার বেশি দিতে হবে। ফল সবজি রক্ষার জন্য বেশি বেশি করে মজুত ঘর তৈরি করতে হবে। কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন ৫০ হাজার কৃষকের উপর সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিল শতকরা ৪৫ ভাগ চাষি বা তার সন্তান আর চাষ না করে অন্য কোনও পেশায় আসতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি তাদের আয় বৃদ্ধির লক্ষণ? নাকি সামাজিক ট্রেন্ড? আসলে কৃষিক্ষেত্রের সাবেকি সংকট থেকে বেরিয়ে কৃষিক্ষেত্রে যথেষ্ট আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ (মেকানাইজেশন) না হওয়াতেই এই প্রবণতা। আধুনিকতার নামে গণদেবতার অনিরুদ্ধ কামারদের শহরে এসে চাকরি খোঁজার চেষ্টাই নব কলেবরে।
আমার প্রশ্ন, মনমোহন সিংহ সরকারের না হয় নীতি-পঙ্গুত্ব ছিল। কিন্তু তিন বছর হয়ে গেল মোদী সরকার কেন স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে পারল না? ন্যূনতম সহায়ক মূল্য চাষিদের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়ার কথা বলেছিলেন স্বামীনাথন। মনমোহনের মনে হয়েছিল, এই সুপারিশ মেনে নিলে চাষিরা দাম পাবে কিন্তু সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি হবে। সেই একই কারণে মোদী সরকার চাষিদের জন্য এই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দিচ্ছে না। তা হলে ভোটের আগে নির্বাচনী ইস্তেহারে বিজেপি ন্যূনতম সমর্থন মূল্য ঘোষণার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন? শুধু ভোটের রাজনীতির জন্য?
প্রাচীন গ্রিসে সর্বহারাদের জনসংখ্যার অংশ ধরা হত না। মোদীর ভারতেও দরিদ্র সমাজের বিবিধ স্তর স্বীকার করা হচ্ছে কই! ইতিহাস রচনা করে যে পরিচয়হীন কোটি কোটি মানুষ, তারাই সভ্যতার পিলসুজ। রাজ্যে রাজ্যে কৃষক সমাজের অসন্তোষের যে স্বতঃস্ফূর্ত ধিকিধিকি আগুন, দোহাই, তাদের উচ্ছৃঙ্খল ইতর জনতা বলবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy