ঊরি সেনা ছাউনিতে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হানায় আঠেরো জন ভারতীয় জওয়ানের শহীদ হওয়ার ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে ভারতে পাকিস্তান বিরোধী জনরোষের তরঙ্গ বয়ে যায়। এর আগে, পার্লামেন্টে সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ, মুম্বই তাজ হোটেলের বাণিজ্য কেন্দ্রের ওপর জঙ্গি হানা এবং পাঠানকোট সেনা ছাউনিতে ভযঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনায় ভারতীয় মনে ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছিল। এ বারে কাশ্মীর উপত্যকায় পুলওয়ামায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সিআরপিএফ কনভয়ের ওপর নৃশংস জঙ্গি হানায় ৪২ জন জওয়ান শহিদ হয়েছেন। এই নৃশংসতা এবং হিংস্রতার বিরুদ্ধে সারা দেশ মুখর হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের ও সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং নিহত শহিদদের স্মরণে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মোমবাতি মিছিল করছে। মাসুদ আজহার ও তার গোষ্ঠী জৈশ-ই-মোহাম্মদ এই আক্রমণের ‘কৃতিত্ব’ দাবি করেছে। যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের আশ্রয় দেয় সে জন্য সারা দেশ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়া পাকিস্তানকে ধিক্কার দিচ্ছে।
বিজেপি’র মধ্যে ‘হিন্দু- তালিবানি’ সম্প্রদায় ও আরএসএসের কট্টর নেতৃবৃন্দের মানুষের মনে পাকিস্তানের ঔদ্ধত্যের একটা যোগ্য জবাব দিতে হবে— এই রকম মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। আশঙ্কা হয়, পাকিস্তান- বিরোধী জনরোষ ধাপে ধাপে মুসলিম-বিরোধী হিন্দু জনরোষে পরিণত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে স্তম্ভের ওপর ভারতের সংবিধান দাঁড়িয়ে আছে, সেকুলারিজমের সেই স্তম্ভ ভেঙে যেতে পারে। সেকুলার ইন্ডিয়া হুড়মুড় করে পড়ে যেতে পারে। দেশভাগের সময় (১৯৪৭) জম্মু-কাশ্মীর স্বাধীন ভূখণ্ডের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। জম্মু কাশ্মীরের রাজা হরি সিং, কাশ্মীরের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ এবং সরল অনাড়ম্বর জনগণের ওপর আক্রমণ নেমে আসে পাকিস্তানের দিক থেকে। দেশভাগের দু’মাসের মাথায় (পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের নিরিখে) ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রণনীতি-কূটনীতি কোন দিক থেকেই পাকিস্তান ভারতে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিতে পারেনি। ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপারে পাক- অনুপ্রাণিত আজাদ-কাশ্মীরের অনুশাসন আর এ পারে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় অনুশাসন চলতে থাকে। সেই থেকে অদ্যাবধি পাক ভারত সম্পর্কের ইতিহাস অসংখ্য চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এই ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা আছে, পাক-ভারত উপমহাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণির ভূমিকা আছে এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে কাশ্মীরের ভূমিকা আছে। সীমান্তের ওপারে দুই মাইল এর মধ্যে অবৈধ জঙ্গি ছাউনিগুলি ধ্বংস করার জন্য ‘ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে এ সব উপাদান গুলির ভূমিকা জেনে বুঝে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে সার্জিকাল স্ট্রাইক শুধুমাত্র ইন্দো-শভিনিজম প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত ব্রাহ্মন্যবাদী ভোটকে সংগঠিত করা নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় তালিবান জামাত হেফাজত ইসলাম এর বিকল্প হিসেবে জপমন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তানের প্রতি যে রোষ আছে তার জবাব দেওয়া এবং বিজয়ীর আস্থা অর্জন করা। তার সঙ্গে তেলের রাজনীতি, চিনের প্রতিরোধ, আমেরিকার পিট চাপড়ানি ইত্যাদি আছে। প্রেক্ষাপট অনেক বড়, তাই তো বহু দেশ আজ ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতকে কর্তৃত্ব জারি রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনাবিল আনন্দে গর্ব ও গৌরব অনুভব করছে।
২
এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইতিহাসের সর্পিল গতিতে অসংখ্য আঁকা বাঁকা পথ ধরে যে প্লাবন ভূমির সৃষ্টি হয় তার ওপরে কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য এবং সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। ভারতে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির পরেও তাকে অপ্রতিহত রাখার জন্য সংবিধানে বিশেষ সুযোগ, ছাড়পত্র, অবস্থান ও মর্যাদা কাশ্মীর প্রশাসনকে দেওয়া হয়। সংবিধানে ৩৭০ নম্বর ধারায় এই বিষয়ে ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, জম্মু-কাশ্মীরে জমিজমা ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক-শ্রেণির (যার অধিকাংশ হিন্দু পন্ডিত) স্থিত স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় তারা তৎকালীন ভারতের জনসঙ্ঘ পার্টির মধ্যে প্রজা পরিষদ গঠন করে এবং ৩৭০ নাম্বার ধারা প্রত্যাহারের দাবিতে সারা রাজ্যে হিন্দু উন্মাদনার সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে গ্রেফতার করে শ্রীনগরের জেলে বন্দি করা হয় এবং বন্দি অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় । সারা উত্তর পশ্চিম ভারতে হিন্দু শভিনিজমের আওয়াজ ওঠে—এক দেশ দো বিধান, এক দেশ দো নিশান, চলেঙ্গে নেহি, চলেঙ্গি নেহি।
এই প্রথম স্বাধীন গণতান্ত্রিক সেকুলার ভারতের রাষ্ট্রীয় সেক্যুলারিজম থেকে হিন্দু শভিনিজমে পরিবর্তন করার প্রবণতা দেখা দেয় এবং তার ফলে জম্মু-কাশ্মীর সরকার নয়, কেন্দ্র সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে।
কংগ্রেসের এককেন্দ্রিক প্রবণতার ফলে কাশ্মীরে মুসলিম জনগণ ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। বক্সি গোলাম মুহাম্মদ এর শাসনকালে যে কাশ্মীরী বুর্জোয়ারা কেন্দ্রীয় বদান্যতায় পুষ্ট হয় তারা সেই প্রথম পাকিস্তান অনুগামীদের চক্রান্তের জালে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর সঙ্কটের সময় ওইসব বুর্জোয়াদের জালে জড়িয়ে পড়েন। তাদের কৃতকর্মের ফলে কাশ্মীরের আহত মুসলিম জনগণ ভারতকে নিজেদের দেশ বলে মনে করতে চায় না। কাশ্মীরে স্বাতন্ত্র্য রাখা বা তার থেকে দেশকে স্বাধীন করার গোপন সশস্ত্র সংগ্রাম এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু হয়। (পাঞ্জাব কাশ্মীর অসমের সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতা সূচনাপর্ব এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য)
১৯৭৫ সালে শেখ আব্দুল্লার সাথে ইন্দিরা গান্ধি চুক্তি করেন। যা কাশ্মীর চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির দ্বারা কাশ্মীরের দরিদ্র জনগণের সাথে কেন্দ্র সরকারের কোন আত্মিক বন্ধন রাজনৈতিক মেল বন্ধন গড়ে ওঠেনি। বরং আহত মুসলিম মন ক্রমে ভারত বিদ্বেষী হয়ে ওঠে এবং পাক-আফগান মুজাহিদীন ও মৌলবাদী কার্যকলাপের এর ক্ষেত্র হিসেবে কাশ্মীরের মাটি উর্বর হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে পাক গুপ্তচর ও দেশদ্রোহী সন্ত্রাসী কার্যকালের অভিযোগে ১৯৮৪ সালে মকবুল ভাটের ফাঁসি হয়। এই ফাঁসিকে কেন্দ্র করে সারা উপত্যাকায় চাপা উত্তেজনা, দগ্ধ অভিমান এবং ক্ষতবিক্ষত আবেগের সঞ্চার হয়। হিংসা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা তাদের উদ্বেল করে তোলে। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনের পর তারা কালো চাদরে ঘেরা সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতার পথে পা বাড়ায়।
এই বিপথগামী যুবকেরা পবিত্র ইসলামের নামে এবং জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের নামে যা করেছে তার পরিসংখ্যান অন্তহীন। শুধু বলা যায়, সভ্যতার ইতিহাস লজ্জায় মুখ ঢাকে জঙ্গিদের এই কৃতকর্মে।আফগানিস্তান পাকিস্তান ইরান— এই তিন মিলিয়ে ভৌগোলিক ভাবে আজ এক গোল্ডেন ক্রিসেন্ট তৈরি হয়েছে। বর্মা থাইল্যান্ড লাওস এই তিন মিলিয়ে গোল্ডেন ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক চোরা কারবারিরা এই সোনালি ত্রিভুজ থেকে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ধরে হেরোইন ব্রাউন সুগার নারকোটিকস এর অবাধ ব্যবসা বাণিজ্য করে। প্যারিস এবং নিউইয়র্ক এর পথে এইসব ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার রোজগার হয়। এই পথের উপর জম্মু-কাশ্মীর-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের অসংখ্য শহর পড়ে। অশুভ আঁতাত ভারতের এই বিশাল এলাকায় জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম রাখতে চায়। কাশ্মীরের জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রেরণায় যোগাচ্ছে এই অশুভ চক্র যার পিছনে আছে পাকিস্তানের ন্যায় এক টেররিস্ট স্টেট এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুগৃহীত কর্পোরেট হাউস বা বুর্জোয়া শ্রেণি।
মতামত লেখকের নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy