Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সিন্ধু, সাক্ষী, আমি...

পারব হিসেবনিকেশ ভুলে নিজের কাজ করে যেতে? পারলে ভাঙাচোরা রাস্তা হবে মসৃণ। দীপা-সিন্ধুদের গাড়ি ছুটে যাবে। মেডেল নয়, মনের ডাকে।শূ ন্য দশমিক এক পাঁচ। সামান্য এই নম্বরের ফারাকে, ত্রিপুরার বদলে ব্রোঞ্জ গেল সুইস তরুণীর গলায়। ঠিক যে রকম ১৯৮৪’তে ০.০১ সেকেন্ডে পিছিয়ে গিয়েছিলেন পি টি উষা। বা ১৯৬০-এ ০.১ সেকেন্ডের জন্য পোডিয়ামে দাঁড়ানো হয়নি ‘ফ্লাইং শিখ’-এর। দশমিকের ভূত ছাপ্পান্ন বছরেও নামেনি এ দেশের ঘাড় থেকে।

অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শূ ন্য দশমিক এক পাঁচ। সামান্য এই নম্বরের ফারাকে, ত্রিপুরার বদলে ব্রোঞ্জ গেল সুইস তরুণীর গলায়। ঠিক যে রকম ১৯৮৪’তে ০.০১ সেকেন্ডে পিছিয়ে গিয়েছিলেন পি টি উষা। বা ১৯৬০-এ ০.১ সেকেন্ডের জন্য পোডিয়ামে দাঁড়ানো হয়নি ‘ফ্লাইং শিখ’-এর। দশমিকের ভূত ছাপ্পান্ন বছরেও নামেনি এ দেশের ঘাড় থেকে।

তবে খালি হাতে ফিরিনি আমরা। দেখলাম হায়দরাবাদ আর হরিয়ানার দুই গর্বিত মা-বাবার চোখে জল। আমারও চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। বিমানবন্দরে ফুল বিছিয়ে এলাম ওদের ফেরার রাস্তায়। চিৎকার করে বলে এলাম: মেরা ভারত মহান।

কিন্তু আমার চোখে জল কেন? আমার গলায় তো আর ঝোলেনি মেডেল। তাতে কী? এ দেশ তো আমার। মেডেল তো আমারই তেরঙ্গার। চোখে জল আসবে না? এখনও সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে গলাটা কেমন ধরে আসে। পাশে কেউ পায়ে পা তুলে বসে পপকর্ন খেলে রাগে জ্বলে যায় শরীরটা। তিনশো বছর পরাধীন রেখে আজ আমাদের ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলবে, আর জবাব দেব না আমি? বলব না, কোহিনুর দিবি না তো মেডেল ছিনিয়ে আনব আজ। সিন্ধু-সাক্ষী পোডিয়ামে উঠলে সেই রাগটাই যে মেটে কিছুটা। যেমন মেটে মঙ্গলে রকেট নামলে, বা পোখরানে বোমা ফাটলে।

তবে আপসোস, মনের মতো জবাবটা দেওয়া গেল না। আটলান্টিক পেরিয়ে অতিমানব ফেল্পসের দেশে নয় নাই গেলাম। কিন্তু অরুণাচলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা চিন? তারা প্লেনে উঠল সত্তরটা মেডেল নিয়ে! আর আমরা মাত্র দু’টো?

তা হলে কি শেষমেশ গায়ের বাদামি রঙটাই হল অভিশাপ? আর একটু কালো হলে দৌড়ে হয়তো নিয়ে আসতাম কয়েকটা সোনা, বা ফর্সা হলে সাঁতারে। না কি, টুইটারে সেই লেখিকার কথাই ঠিক! দেশের মর্যাদা ভুলে দীপাদের মন ছিল সেলফির দিকে। ভীষণ রাগ হয়। দাঁতে দাঁত চেপে দেশের লজ্জা সহ্য করি আমি।

সত্যিই কি এ লজ্জা দেশের? না কি শুধু আমার? ভণ্ড দেশপ্রেম ঢাকতে পতাকাকে হাতিয়ার করেছি আমি। পশ্চিমকে গাল দিয়ে, তাদেরই অলঙ্কারে কি আজ অভ্যস্ত আমি? তাই স্কাইস্ক্রেপার আর ক্রেডিট কার্ডের মতো মেডেলটাও প্রয়োজন আমার, পরাধীন তিনশো বছরের থেকে যাওয়া হীনম্মন্যতা ঢাকতে? ওর আছে, আমার কোথায়? আর খেলার চ্যানেল খুলে খুঁজে বেড়াই ক্ষমতার চাবি। খেলা দেখি না আমি। দেখলে হেরে যাওয়া ইডেনের বুকে বোতল ছুড়তাম না সেই সন্ধেবেলা। অভিমানের আগুনে সে দিন পুড়েছিল দেশের মর্যাদা। তোয়াক্কা করিনি আমি।

মনে পড়ে মুম্বইয়ের বৃদ্ধ মেকআপ-ম্যান গোভিলের কথা। ছেলেবেলায় গ্রামে বাবার সচ্ছল ব্যবসা ছেড়ে পালিয়েছিলেন রাজেশ খান্নাকে দেখবেন বলে। সারা জীবন কাটান ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ, রাজেশের সঙ্গে। অথচ যশ, অর্থ কোনওটাই ছিল না তাঁর। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপসোস হয় না আজ?’ বলেছিলেন, ‘ঝাড়ু ভি মারনা তো অ্যায়সে মারনা কে লোগ সও বার পুছে কি ঝাড়ু কিসনে মারা।’ অর্থাৎ ঝাঁট দিলেও এমন ভাবে দিও যাতে সবাই জিজ্ঞেস করে কে ঝাঁট দিয়েছে। বলেছিলেন তিনি, ‘ম্যায়নে দিলকি শুনি, দিলসে কাম কিয়া, বাকি ভগবান কে নাম।’

মনের কাজ মন দিয়ে করেছিলেন গোভিল। আমি বোকা বলি তাঁকে। লাভলোকসানের হিসেব না করেই তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন মনের কথায়। আমি বুদ্ধিমান, শহরের কোলাহলে কায়দা করে হারিয়ে ফেলেছি সেই মনের ডাকটা। তাই আমার বিবেকবুদ্ধিকে কেউ খোঁচা মারে না আর। বৃষ্টি ভেজা বিকেলে বারান্দায় ভুল করে যদি কখনও চোখ পড়ে যায়, কংক্রিট চেরা আকাশের সরু ফালিটার দিকে, দেখি গোলাপি মেঘ ওই নীল ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে হেসে চলে যায়। তখন কানে বাজে একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। বিচলিত হই না, জানি পরমুহূর্তেই ট্র্যাফিকের আওয়াজে হারিয়ে যাবে ওটা। ভয় পেলে মানিব্যাগ খুলে দেখে নিই খাঁজে খাঁজে উঁকি মারছে কি না সাপের চকচকে চামড়ার মতন ক্রেডিটকার্ডগুলো। ভয় পাই, বিনা লাভে কাজ করলে যদি কাচের ওপারে ম্যানিকিন না তাকায় আর।

তাই মাইনের কাগজ আর কাজের ওজনটা দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিই বার বার। দেরি করে অফিস ঢুকি। সিগনালে লরি থামিয়ে বাড়িয়ে দিই হাতখানা। ডাক্তার হয়ে রোগীকে দেখিয়ে দিই পছন্দের রক্তপরীক্ষার সেন্টার। সোডাতে দামি মদ মেশালেও ফ্লাইওভারে মেশাই কম দামি সিমেন্ট বালি।

আমি ভুলে গেছি দীপার দৌড়টা রিও-র ওই রানওয়েতে নয়, শুরু আমারই ভারতবর্ষের ভাঙাচোরা রাস্তায়। যা গিয়েছে আমারই বাড়ির সামনে দিয়ে। যেখানে কখনও আমি করেছি অবরোধ, কখনও বা ট্যাক্সিতে ‘নো রিফিউজাল’ লিখে ফিরিয়ে দিয়েছি অসুস্থ সওয়ারি। থানায় আসা ছাত্রকে পাসপোর্ট দিয়ে হাসি মুখে বলেছি, ‘মিষ্টি খাবার পয়সাটা?’ সাক্ষী-সিন্ধু-দীপাদের খাবারে ভেজাল মিশিয়ে পিঠে হাত রেখে বলেছি, ‘সোনার মেডেলটা কিন্তু চাই এ বার।’ সামনে তাকাইনি, তাকিয়েছি নীচে। যেখানে নিরাপত্তার মরীচিকা মঞ্চ মচমচ শব্দে নড়ে উঠেছে বার বার।

যখন কোনও অজানা শক্তির টানে, কেউ সেই কাদা-ভরা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে পোডিয়ামে, গলায় পরেছে প্রবল ইচ্ছাশক্তির মেডেল, তখন লোভীর মতো ভাগ বসাতে চেয়েছি তাতে। বুক ফুলিয়ে বলেছি, ‘ও তো আমারই দেশের।’ কিন্তু যখন রোদে-জলে ভিজে সে এগিয়েছে মনের ডাকে, আমি বেছে নিয়েছি সভ্যতার শর্টকাট। এসি গাড়ির কাচ তুলে একটু জিরিয়ে নিয়েছি আমি।

আর সেই দশমিকের ফারাক? ওটা আমার আলিস্যি ভরা চোখের ভুল দেখা। দীপা-উষা পেরিয়েছে তাদের গোটা পথটাই। বাকিটুকু পথ আমার। ওটা চলতে হত আমাকেই। বহু আগে যে পথ পার করেছে চিন, জাপান, আমেরিকা। তাই ফেল্পসের গলায় ঝোলে যে সোনাগুলো, সেটা আমেরিকার হলেও, সিন্ধুর রুপোটা কিন্তু ওর একার। ওটা নিজের বলার অধিকার এখনও অর্জন করিনি আমি। ভুল বুঝেছি। ভেবেছি সভ্যতার মাপকাঠি ওই উঁচু কংক্রিটগুলো। বুঝিনি অট্টালিকার তলা নয়, মনের তলে লুকিয়ে ছিল সভ্যতা।

পারব আমি গোভিল হতে? লাভ-লোকসানের হিসেব ভুলে নিজের কাজটুকু করে যেতে? পারলে বাড়ির সামনের সেই ভাঙাচোরা রাস্তাটা অজান্তেই হবে এক দিন মসৃণ। দীপা-সিন্ধুদের গাড়ি সে দিন ছুটে যাবে সভ্যতার ধুলো উড়িয়ে। মেডেল আনতে নয়, মনের ডাকে। সে দিন মেডেল গুনব না আমি, কারণ সভ্যতা মুছে দেবে আমার হীনম্মন্যতা।

না পারলে হেরে যাব আমি। হয়তো শপিং মলের উর্দি পরা সিকিয়োরিটি ঠুকবে কিছু শুকনো সেলাম, কিন্তু আমি জানব আমি পরাজিত। মানিব্যাগে রাখা হাজার কার্ডও ঢাকতে পারবে না সে হার। জিতবে দীপা, সিন্ধু আর গোভিলরা। তাদের গলায় থাক মেডেল বা ঘামে ভেজা গামছা। স্কাইস্ক্রেপার বা ফুটপাথ যাই হোক না কেন তাদের ঠিকানা, তারা জিতবেই। কারণ মনের কাজটা তারা করেছে মন দিয়ে, দাঁড়িপাল্লা দেখে নয়। কংক্রিটের সভ্যতা চিরে, নীল আকাশের ফালিতে তারা শুনেছে গোলাপি মেঘের ডাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE